ঢাকা, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১১:০৪ পূর্বাহ্ন
ঘুঁটেই ভরসা, রূপগঞ্জে রান্নায় ঘুঁটেই ভরসা/ঘুঁটে শিল্পের জনপ্রিয়তা বাড়ছে
Reporter Name
রূপগঞ্জে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে গোবরের ঘুঁটে/ গ্যাস নেই, ঘুঁটেই ভরসা/ রূপগঞ্জে রান্নায় ঘুঁটেই ভরসা/ঘুঁটে শিল্পের জনপ্রিয়তা বাড়ছে

আব্দুল মুমিন, রূপগঞ্জ:  “রাজধানী ঢাকার অতি সন্নিকটে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা। গোটা দেশে উন্নয়ণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও অদৃশ্য কারণে রূপগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরের বাসিন্দারা আজও অবহেলিত। ঢাকার কাছে হলেও ঢাকা যেতেই লাগে এক দেড়ঘন্টা। অথচ বালুনদীর উপর সেতু হলে ঢাকা যেতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট। গ্যাস নেই কোনো কালেও। মাটির চুলায় ঘুঁটে দিয়েই রান্না কাজ সারতে হয়। কি আর করা, সরকার তো দিচ্ছে না। তাই মাটির চুলা আর গরুর গোবরের ঘুঁটেই আমাদের ভরসা।” এমনি করে কথাগুলো বলছিলেন উপজেলার দেইলপাড়া এলাকার লাকি বেগম।

বাংলাদেশের কৃষিউৎপাদন ব্যবস্থা খুব ধীর গতিতে হলেও পরিবর্তিত হচ্ছে। বাস্তব কারণেই কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহারও ক্রমশ বাড়ছে। আগের দিনে প্রতিটি গৃহস্থ বাড়িতে জমিচাষ, ফসল মাড়াই, ফসল পরিবহন, বিক্রি ও যোগাযোগ কাজের জন্য গরু ব্যবহারের প্রচলন ছিল। সেই সময় গোবর ফসলের জমিতে ব্যবহার বা জ্বালানি তৈরির জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষণের প্রচলন ছিল। গোবরের জ্বালানিই তখন ছিল বর্ষাকালে রান্নার অন্যতম উপকরণ-শহর এবং গ্রাম উভয়ক্ষেত্রেই। এখনও  রান্নার কাজে এই জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের দেইলপাড়ার রাবেয়া, লাকী, অঞ্জনা, ববিতা, মিনা, আখি গোবরের লাকড়ি তৈরি করে বিক্রি করছেন প্রায় ২০ বছর যাবৎ। হাতে তৈরি এক বস্তা ঘুঁটে ২০০শ থেকে ৩০০শ টাকায় বিক্রি করেন।  প্রতিটি লাকড়ি ১০-১৫ টাকায় বিক্রয় করে প্রতিবছর ১২-১৪ হাজার টাকা আয় করেন বলে জানালেন। তার মতো গ্রামের অনেক নারীই গোবর দিয়ে জ্বালানি তৈরি ও বিক্রয় করে পারিবারিক স্বাচ্ছন্দ্য আনতে ভূমিকা রাখছেন।

ঘুঁটে দিয়ে যেমন রান্না হচ্ছে আবার অতিরিক্ত ঘুঁটে বিক্রি করে সংসারের জন্য বাড়তি আয়ও হচ্ছে। ঘুঁটে তৈরিও খুব সহজ। সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে গাঁয়ের বৌ ঝিরা মাঠে, রাস্তার পাশে, উঠানে জমানো গোবর দিয়ে ঘুঁটে তৈরির কাজ শুরু করেন। সাধারণতঃ নরম থাকতে থাকতে গোবরকে ঘেঁটে সমসত্ত্ব করে গোল তাল পাকিয়ে সেগুলি হাতের সাহায্যে দেয়াল বা তেমন কোন শক্ত তলের উপর থপ থপ করে থেবড়ে দিয়ে চ্যাপ্টা করা হয়। একেই বলে ঘুঁটে দেয়া। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “”বড় বৌ, মেজ বৌ, সেজ বৌ মিলে, ঘুঁটে দেয় ঘরের পাঁচিলে।।” গোবর বাতাসের সংস্পর্শে ও রোদে শুকিয়ে শক্ত হয়ে ঘুঁটে হয়ে যায়। জলীয় অংশ কমে যাবার ফলে এর আয়তন সঙ্কোচন হয়। হাতে করে থেবড়ানোর ফলে ঘুঁটের বাইরের তলে হাতের তিন চার আঙুলের ছাপ থাকে। পিছনের তলটি সাধরণতঃ দেয়ালের ন্যায় সমতল হয়। দেয়ালগুলি এমন ভাবে বাছা হয় যাতে রোদ পড়ে ও ঘুঁটে তাড়াতাড়ি শুকায়। শুকিয়ে গেলে ঘুঁটে দেয়াল থেকে সহজেই খসিয়ে নেয়া যায়। কাচা ঘুঁটে দেয়াল থেকে খোলার চেষ্টা করলে ভেঙে যায়। প্রায় শোকানো ঘুঁটে দেয়াল থেকে ছাড়িয়ে নেবার পর গোছা গোছা করে রোদে রেখে আরো ভালো করে শুকানো হয়। তখন ঘুঁটে সমতল না থেকে একটু বেঁকে চুরে যেতে পারে। যে ঘুঁটে যত ভালো শুকানো হয় তা ততো সহজে জ্বালান যায়। তাই ভালো করে শুকানো ঘুঁটের কদর বেশী। এক একটি ঘুঁটে দেখতে বড়সড় মনে হলেও ঘুঁটে সমান আয়তনের কয়লা বা এমনকি কাঠের থেকেও অনেক হালকা।

দেয়ালের গায়ে চাকতি আকৃতির ঘুঁটে দেওয়া হয়। রৌদ্রে শুকিয়ে গেলে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করা হয়। গরুর মল অর্থাৎ গোবর  শুকিয়ে গেলে তাকে বলে ঘুঁটে। শুকালে গোবরের চটচটে ভাব বা গন্ধ কোনটিই থাকে না, রংও ভিজে গোবরের থেকে অনেকটা ফরসা হয়ে যায়। ঘুঁটে নানা দেশে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে গোবরকে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহারের জন্য গোল গোল চ্যাপ্টা চাকতি হিসাবে শুকানো হয়। ঘুঁটে বলতে সাধারণতঃ এই খয়েরী রঙের চাকতিগুলিকে বোঝানো হয়। বাংলাদেশে এরকম ঘুঁটে ছাড়াও আরেক রকমের ঘুঁটে তৈরি হয়। যেমন পাটখড়ি/পাটকাঠিতে গোবর মাখিয়ে শুকানো হয় এবং তার পর লাকড়ির মত ব্যবহার হয়। এছাড়াও গরুর গোবর থেকে জৈব সার, কেঁচো সার, কীটনাশক ও বায়োগ্যাস উৎপাদন শুরু হয়েছে অনেক দিন ধরেই। অতি সাধারণ জৈববর্জ্য গোবর আজ তাই শুধু জমির সার আর জ্বালানিই নয়। গোবরেরও রয়েছে সম্ভাবনাময় নানা দিক। গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত হতে পারে সম্ভাবনার সেই অপার দিগন্ত; যা মানুষ ও পরিবেশের জন্য ভবিষ্যতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়।

উপজেলা পশু কর্মকর্তা ডাঃ রিগান মোল্লা বলেন, ঘুঁটে জ্বালানী হিসাবে কাজ করে কারণ গরু মোষের মলে অনেক অপরিপাচিত বা অর্ধপাচিত ঘাস ইত্যাদির কাষ্ঠল তন্তু থাকে যা সহজেই জ্বলে। এর কিছু অংশ দাউদাউ করে জ্বলে গেলেও বাকী অংশ অনেক্ষণ অবধি ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে, যাতে ভালো ধীর আঁচের রান্নাও করা যায়। ঘুঁটের আগুনে মাঝারি রকমের ধোঁয়া হয়। এই ধোঁয়ায় আবার মশা তাড়ানোর জন্যও অনেক সময় ব্যবহার হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক অফিসার ডাঃ ফয়সাল আহমেদ বলেন, গ্রামবাংলায় বিশেষ করে গোয়াল ঘরে রাত্রে মশা তাড়াবার জন্য ঘুঁটের ধুনি জ্বেলে রাখার রেওয়াজ আছে। ঘুঁটের ছাই/ভষ্ম  প্রায় সাদা, ঈষৎ কালচে (একে “ছাই বলা হয়)। ঘুঁটের ছাই এক সময় গ্রামে দাঁত মাজার জন্যও ব্যবহার হতো। খুব নরম এবং কয়লার ছাইয়ের মত শক্ত নয়।  তাই দাঁতের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা কয়লার ছাইয়ের থেকে খুবই কম। কয়লার ছাই দিয়ে দাঁত মাজলে কাঁকড়ে দাঁতের এনামেল ক্ষয় হবার সম্ভাবনা থাকে।

2 responses to “ঘুঁটেই ভরসা, রূপগঞ্জে রান্নায় ঘুঁটেই ভরসা/ঘুঁটে শিল্পের জনপ্রিয়তা বাড়ছে”

  1. … [Trackback]

    […] Find More on that Topic: doinikdak.com/news/17462 […]

  2. … [Trackback]

    […] Find More to that Topic: doinikdak.com/news/17462 […]

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x