ঢাকা, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৯:০৬ অপরাহ্ন
বিএনপিতে বাড়ছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল
হাবিবুর রহমান খান

সারা দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল। পুনর্গঠন ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দলের অবস্থা প্রকাশ্যে চলে আসছে। কমিটি দেওয়ার পর তা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হচ্ছে। দাঁড় করানো হচ্ছে পালটা কমিটি। ঘটছে পদত্যাগের ঘটনাও। অনেকেই ক্ষোভে রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন।

এই কোন্দলের পেছনে কেন্দ্রীয় নেতাদের ইন্ধন আছে বলে অভিযোগ করেন বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী। এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখতে নিজের অনুসারীদের যেকোনো মূল্যে নেতৃত্বে আনতে মরিয়া তারা। তদবির আর অনৈতিক উপায়ে সুবিধাবাদীরা চলে আসছে শীর্ষ নেতৃত্বে। বাদ পড়ছেন যোগ্য ও ত্যাগীরা। পুনর্গঠনের গতি বৃদ্ধির সঙ্গে ভবিষ্যতে এ কোন্দল আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। যা আগামী দিনে সরকারবিরোধী আন্দোলন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন নেতাকর্মীরা।

তবে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়টি মানতে নারাজ দলের নীতিনির্ধারকরা। জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, করোনা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হওয়ায় আমরা ফের পুনর্গঠন শুরু করেছি। ঢাকা মহানগরসহ বেশ কিছু কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। চলছে অঙ্গ সংগঠনগুলোর পুনর্গঠনও। নানা ঝড়ঝাপটার পরও বিএনপি থেকে একজন নেতাও অন্য দলে যায়নি। দলে যে কোন্দল নেই এটাই তার বড় প্রমাণ।

তিনি বলেন, বিএনপি এ দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। সারা দেশে লাখ লাখ নেতাকর্মী আছে। কিন্তু সে তুলনায় পদের সংখ্যা কম। তাই যোগ্যতা থাকার পরও সবাইকে গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা সম্ভব হয় না। ফলে অনেকের মধ্যে পদ না পাওয়া নিয়ে কিছুটা অভিমান থাকতে পারে। সেটাকে আমরা কোন্দল বলছি না। নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো অভিমান বা কারও কোনো অভিযোগ থাকলে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা তা সমাধানের চেষ্টা করছি।

সূত্র জানায়, ডিসেম্বরের মধ্যেই পুনর্গঠন শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর পর থেকেই কেন্দ্রীয় নেতা ও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নড়েচড়ে বসেছেন। এলাকায় নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে ব্যস্ত তারা। মূলদলসহ অঙ্গ সংগঠনে নিজেদের অনুসারীদের শীর্ষ নেতৃত্বে আনার চেষ্টায় ত্রুটি করছেন না। তাদের এমন মুখোমুখি অবস্থানের কারণে বেশ কিছু জেলায় বারবার উদ্যোগ নেওয়ার পরও নতুন কমিটি দিতে পারছেন না দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। আবার যেখানে কমিটি দেওয়া হচ্ছে সেখানে যে গ্রুপের নেতাকর্মীরা বাদ পড়ছেন তারা এ বিদ্রোহের পেছনে ইন্ধন দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, ২৫ আগস্ট ঘোষণা হয় মুন্সীগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি। আগের সভাপতি আব্দুল হাই ও সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান রতনকে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব করে এ কমিটি দেওয়া হয়। এতে ক্ষুব্ধ হন জেলার নেতাকর্মীরা। কেন্দ্রের দেওয়া আহ্বায়ক কমিটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে গঠন হয় পালটা কমিটি। ২ সেপ্টেম্বর মুন্সীগঞ্জ প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও হরহঙ্গা কলেজের সাবেক ভিপি মো. রফিকুল ইসলাম মাসুমকে আহ্বায়ক ও মিয়া মো. বাবুল সরকারকে সদস্য সচিব করা হয়। পালটাপালটি কমিটি কেন্দ্র করে জেলায় সৃষ্টি হয়েছে উত্তেজনা। নেতাকর্মীরাও বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। যেকোনো সময় বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে রফিকুল ইসলাম মাসুম বলেন, যাদের দিয়ে কেন্দ্র জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি করেছে তারা পুরোপুরি ব্যর্থ। পাঁচ বছরে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কোনো কমিটি হয়নি। এমনকি জেলা কমিটিই পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি। অথচ ব্যর্থ সেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। বিগত সময়ে যারা রাজপথে ছিলেন তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রদলের সাবেক নেতাদের রাখা হয়নি।

কমিটি গঠন কেন্দ্র করে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে সিলেট বিএনপিতে। কোন্দলে বিপর্যস্ত জেলার রাজনীতি। সম্প্রতি জেলা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি ঘোষণা কেন্দ্র করে ফের প্রকাশ্যে আসে কোন্দল। যোগ্য ও ত্যাগীদের বাদ দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হন কেন্দ্রীয় বিএনপি সহ-স্বেচ্চাসেবক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামসুজ্জামান জামান। সিদ্ধান্ত নেন কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে পদত্যাগের। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বরাবর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। পরে তার অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে ২০ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে দল থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। জামানের পর নবগঠিত সিলেট জেলা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের ১১ নেতা পদত্যাগ করেন। এতে সিলেট বিএনপিতে শুরু হয় উত্তেজনা। বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো জেলায়। ঘোষিত কমিটি বাতিল করা না হলে জামানের অনুসারীরা গণপদত্যাগের ঘোষণা দেন। এরই মধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় জামানের অনুসারী কয়েকশ নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছেন, আরও অনেকে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জামানের গ্রুপের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধলেও জেলার আরেক প্রভাবশালী নেতা চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদির গ্রুপ বেশ ফুরফুরে। তারা শহরে নিয়মিত মহড়া দিচ্ছেন। কমিটির পক্ষে করেছেন আনন্দ মিছিলও। বলতে গেলে সিলেট জেলা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের পুরো নিয়ন্ত্রণই এখন মুক্তাদির গ্রুপের হাতে। দলের হাইকমান্ডও তার প্রতি নমনীয়। ফলে বিদ্রোহকে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এর আগে যুবদলের কমিটি গঠনের পর মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীসহ সিলেট বিএনপির কেন্দ্রীয় চার নেতা পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এক সপ্তাহের মধ্যে সমাধানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আশ্বাসে তারা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।

এদিকে সম্প্রতি ময়মনসিংহের নান্দাইলে হামলা-মামলায় জর্জরিত ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর নবগঠিত কমিটির ১৮ নেতা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে উপজেলা কমিটির ১০ জন এবং পৌর কমিটির আটজন রয়েছেন। সাত সেপ্টেম্বর তারা পদত্যাগ করেন। এর আগে একই অভিযোগে হালুয়াঘাট ও গৌরীপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের ২৩ নেতা নতুন কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন।

এদিকে সম্প্রতি ঘোষিত ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির কমিটি নিয়েও নেতাকর্মীদের রয়েছে চাপা ক্ষোভ। দলের দুঃসময়ে মাঠে থাকলেও অনেককে রাখা হয়নি কমিটিতে। ফলে অভিমানে দলীয় রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন। আগের কমিটির গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন নেতাকে এখন আর কর্মসূচিতে দেখা যায় না। দুই সিটির নবগঠিত কমিটি শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা জানালেও এসব নেতা সেখানে যাননি।

জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান যুগান্তরকে বলেন, করোনা পরিস্থিতি কমে আসায় ফের পুনর্গঠন শুরু হয়েছে। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও সবাইকে কমিটিতে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কোথাও কোথাও নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছুটা অভিমান রয়েছে। তা নিরসনের চেষ্টা চলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x