ঢাকা, মঙ্গলবার ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০২:১৯ অপরাহ্ন
ছবিটির দিকে তাকানো যায় না
সাজেদুল হক

আইন সাংবাদিকদের একটি ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে প্রথম ছবিটি দেখি। বুকটায় কেমন যেন ব্যথা শুরু হয়। ডেইলি স্টারের এমরান হোসেনের তোলা। ছোট্ট সাফার ছবিটির দিকে তাকানো যায় না। মুহূর্তে মনে পড়ে যায় সাংবাদিকতার ক্লাসে বারবার বলা শিক্ষকদের কথা। একটি ছবি কখনও কখনও হাজার বা লাখো শব্দের চেয়েও শক্তিশালী। আসলেই কি তাই? কোনো শব্দ বা বাক্যের ক্ষমতা আছে এই ছবিটি ব্যাখ্যা করার? কী যন্ত্রণা, কী কষ্ট, কী বেদনা বহন করে এই ছবি! কার সাধ্য আছে সে কথা বলার!

৩০শে আগস্ট। আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস।

গেলো ক’ বছর ধরে দিনটিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবে হাজির হন গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা। বুকে তাদের প্রিয় মানুষের ছবি। কারও বাবার, কারও ভাইয়ের। অনেকের মতো গতকাল প্রেস ক্লাবে এসেছিল ছোট্ট সাফা। বাবা মাহফুজুর রহমান সোহেলকে খুঁজছে সে। সবার কাছে তার আকুতি, আপনারা আমার বাবাকে ফিরিয়ে দেন।

হারিয়ে যাওয়া ছাত্রদল নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন আফরোজা ইসলাম আঁখির সঙ্গে কথা বলেন আমাদের রিপোর্টার শাহনেওয়াজ বাবলু। অডিও রেকর্ড শুনি। সহ্য করা যায় না। তিনি বলতে থাকেন, আমার ভাইয়ের ছোট মেয়েটা কেমন যেন হয়ে গেছে। অন্য বাচ্চাদের থেকে একদম আলাদা। ভাইকে যখন তুলে নিয়ে যায় তখন ওর বয়স এক বছর। বেড়ে ওঠার সময়টায়ও ঠিক যত্নটা পায়নি। ২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয় এই ছাত্রদল নেতাকে। এরপর থেকে আজও তার খোঁজ মিলেনি। অপেক্ষায় বৃদ্ধা মা। প্রায়ই জানতে চান ছেলে কবে ফিরবে? অপেক্ষায় পরিবারের অন্য সদস্যরাও। তাদের এই অপেক্ষা কবে শেষ হবে কেউ জানে না।

এমন অপেক্ষায় আরও অনেকে। কেউ ফিরে, কেউ ফিরে না। কেউবা ফিরে লাশ হয়ে। জীবিত যারা ফিরে আসেন তাদের অনেকে চলে যান আড়ালে। গণমাধ্যমের সামনে একেবারেই মুখ খোলেন না। কী যেন ভয় তাড়া করে ফিরে তাদের। হারিয়ে যাওয়া মানুষ যায় কোথায়? সে প্রশ্নের উত্তর আজও অজানা।

গণমাধ্যম থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, ২০০৭ সাল থেকে গত ২৫শে আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৬১৪ জনের গুমের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ৯৪ জনকে। ফেরত এসেছেন ৫৭ জন। অন্যদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা জানা যায়নি।

এই গুমের মর্মান্তিক পরিণতির কথা ভাবতে ভাবতে মানবাধিকার কর্মী মীনাক্ষী গাঙ্গুলির একটি পুরনো লেখার কথা মনে পড়ে। তিনি লিখেছিলেন, ‘সরকারের অস্বীকার করাই হচ্ছে বলপূর্বক গুমের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। প্রিয়জন হয়তো বহু বছর ধরে এক অনিশ্চয়তা নিয়ে বাঁচে, আশা আর নিরাশার দোলাচলে। মায়েরা চিন্তিত থাকেন, তাদের সন্তান যদি কখনও ফেরেও, তাহলে তাকে চেনা যাবে কিনা। ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে যেসব নারী তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বামীর খোঁজে এখনও অপেক্ষায় আছেন তাদের বলা হয় ‘অর্ধ-বিধবা’। গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার জানিয়েছে, তারা শোকও প্রকাশ করতে পারেন না ঠিকঠাকভাবে। তারা অস্থির থাকেন এই ভেবে যে, তাদের প্রিয়জন কি এখন নির্যাতন ভোগ করছে, নাকি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে, কবরে শায়িত হওয়ার মর্যাদা কি সে পেয়েছে? আজকের বাংলাদেশে, বহু পরিবার এমন প্রশ্ন নিয়ে বেঁচে রয়েছে।’

গতকালই প্রেসক্লাবে এক মা বলেন, আমরা আর গুমের ভার বহন করতে পারি না। কতদিন আর এই কষ্ট সহ্য করবো। আরেক নারী জানান, স্বামী নিখোঁজ থাকায় সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়েও ঝামেলায় পড়েন তিনি। তিনি বলেন, কাউকে বলা যায় না যে আমার সন্তানের বাবা নিখোঁজ হয়ে আছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং ওর বন্ধুরা জানে যে, ওর বাবা বিদেশে আছে।

ছোট্ট সাফার কথা বলছিলাম। তার ছবিটি মাথা থেকে নামানোই যাচ্ছে না। কী যন্ত্রণা আর কষ্ট বহন করে চলেছে এই বাচ্চাটি। আমাদের কী করার আছে ভাবতে ভাবতে যন্ত্রণায় নীল হই। প্রার্থনা করি, সাফা যেন ওর বাবাকে ফেরত পায়। সবার যেন একটু করুণা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.