ঢাকা, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ০২:২২ অপরাহ্ন
বঙ্গবন্ধুর লিখনি ও ভাষণে ইসলামী মূল্যবোধ
কাসেম শরীফ

ধর্ম ও ধার্মিকতা বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক ঐতিহ্য। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ে এ বিষয়ে ইঙ্গিত আছে। তিনি লিখেছেন, ‘আমার জন্ম হয় টুঙ্গিপাড়া শেখ বংশে। শেখ বোরহানউদ্দিন নামে এক ধার্মিক পুরুষ এই বংশের গোড়াপত্তন করেছেন বহুদিন পূর্বে।’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, দ্বিতীয় মুদ্রণ, সেপ্টেম্বর ২০১২, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৩)

কাজেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তে-মাংসে ধর্ম ও ধার্মিকতা বিদ্যমান। আর এমন ব্যক্তির কথাবার্তায় ঈমানদীপ্ত উপাদান থাকবে—এমনটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধুর কথা, লেখা ও ভাষণ থেকে নিম্নে এমন কিছু বিষয় উল্লেখ করা হলো—

মুসলমানদের ইতিহাস পড়ে রাজনীতির প্রেরণা : মুসলমান বীরের জাতি। যুগে যুগে তারা জালিমের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। সে ইতিহাস রপ্ত ছিল বঙ্গবন্ধুর। ওই ইতিহাস তাঁকে রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এদিকে ইঙ্গিত করে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘সিপাহি বিদ্রোহ এবং ওহাবি আন্দোলনের ইতিহাসও আমার জানা ছিল। কেমন করে ব্রিটিশরাজ মুসলমানদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল, কি করে রাতারাতি মুসলমানদের সর্বস্বান্ত করে হিন্দুদের সাহায্য করেছিল, মুসলমানরা ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিদারি, সিপাহির চাকরি থেকে কিভাবে বিতাড়িত হল—মুসলমানদের স্থান হিন্দুদের দ্বারা পূরণ করতে শুরু করেছিল ইংরেজরা কেন? মুসলমানরা কিছুদিন পূর্বেও দেশ শাসন করেছে, তাই ইংরেজদের গ্রহণ করতে পারে নাই। সুযোগ পেলেই বিদ্রোহ করত। ওহাবি আন্দোলন কি করে শুরু করেছিল হাজার হাজার বাঙালি মুজাহিদরা? বাংলাদেশ থেকে সমস্ত ভারতবর্ষ পায়ে হেঁটে সীমান্ত প্রদেশে যেয়ে জেহাদে শরিক হয়েছিল। তিতুমীরের জেহাদ, হাজী শরীয়তুল্লাহর ফারায়েজি আন্দোলন সম্বন্ধে আলোচনা করেই আমি পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাস বলতাম।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ২২-২৩)

এই উদ্ধৃতি থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায়, মুসলমানদের ইতিহাস পড়েই রাজনীতির প্রেরণা পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ‘ইনশাল্লা’ : বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মুুক্তিযুদ্ধ সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা। পাকিস্তানিরা যখন বাঙালিদের ওপর এক অন্যায় সমর চাপিয়ে দিল, তখন যুদ্ধ ছাড়া এ দেশের মানুষের কাছে বিকল্প আর কিছু ছিল না। সেদিনের সমরনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চ ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ভাষণে ওই বিকল্পের সমাধান ঘটে। বঙ্গবন্ধু সেদিন তেজোদীপ্ত কণ্ঠে জনগণের উদ্দেশে বলেন, ‘মনে রাখবা—রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব; এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লা। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ (ভাষণের টেক্সট—শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বিশ্বসাহিত্য ভবন, ঢাকা-২০১২, পৃষ্ঠা ২৫৫)

যাঁরা ধর্মনিষ্ঠ, তাঁরা মনে করেন, ভাষণের ওই একটি শব্দ, ‘ইনশাল্লা’ গোটা দৃশ্যপট বদলে দেয়।

‘ঈমানই মুসলমানদের সেরা হাতিয়ার’ : করাচির কোরাঙ্গিতে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন অনুষ্ঠানে তত্কালীন আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, স্বৈরাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছেন এবং সাধারণ মানুষের বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত তিনি ক্ষান্ত হবেন না।

৯ আগস্ট ১৯৬৯ ওই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, পাকিস্তানের জন্য তাঁরা যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন, বর্তমান সংগ্রাম তারই ক্রমবিকাশ। মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি কায়েমের ২২ বছর পরও এই সংগ্রাম অব্যাহত আছে।

শেখ সাহেব বলেন, অবিচার ও স্বৈরাচারের সঙ্গে তিনি কখনো আপস করেননি এবং অতীতে এ জন্য নির্যাতন ভোগ করেছেন। তিনি বলেন, প্রয়োজন হলে ভবিষ্যতেও তিনি নির্যাতন ভোগের জন্য প্রস্তুত আছেন।

তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ‘ঈমানই মুসলমানদের সেরা হাতিয়ার এবং মুসলমানদের একমাত্র আল্লাহকেই ভয় করা উচিত। এই খোদাভীরুতাই মুসলমানকে জীবনের বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সহায়তা করে।’

আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তিনি বহুবার সুযোগ পেয়েছিলেন; কিন্তু সেসব সুযোগ তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। কারণ এসব ক্ষেত্রে নীতির সঙ্গে আপসের প্রশ্ন জড়িত ছিল। শেখ সাহেব মসজিদ নির্মাণ তহবিলে তাঁর এবং তাঁর সহকর্মীদের তরফ থেকে ৫০১ টাকা দান করেন। (সূত্র : ইত্তেফাক, রবিবার, ২৬ শ্রাবণ ১৩৭৬, ১০ আগস্ট ১৯৬৯)

বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ‘নারায়ে তাকবির’ : স্বাধীনতাসংগ্রামের আগে ৪ জানুয়ারি ১৯৭১ রমনা রেসকোর্সের বিশাল জনসমাবেশের সভাপতি আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিম্নোক্ত ধ্বনি দিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন, ‘নারায়ে তাকবির’—‘আল্লাহু আকবার’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘আমার দেশ তোমার দেশ—বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘জাগো জাগো—বাঙালি জাগো’ ও ‘জয় বাংলা’। অগণিত মানুষ নেতার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে ধ্বনি দেয়। (সূত্র : ইত্তেফাক, সোমবার ১৯ পৌষ ১৩৭৭, ৪ জানুয়ারি ১৯৭১)

১৯৭০ সালে নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধুর ঈমানদীপ্ত শপথ : ১৯৭০-এর নির্বাচনে আল্লাহর অনুগ্রহে বঙ্গবন্ধুর দল বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি দলের মনোনয়নে বিজয়ী কেন্দ্রীয় পরিষদের ১৫১ জন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ২৬৭ জন সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা বাস্তবায়নের শপথ নেন। এই শপথ অনুষ্ঠান তিনি ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে সম্পন্ন করেন। এই ঘটনার সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক তাত্পর্য ছিল। (সূত্র : আতিউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ : ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ১০৬)

ওই শপথনামা প্রসঙ্গে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, “হলফনামা একটি ছাপা দলিল। আল্লাহর নামে এই হলফনামার শুরু হয়েছিল। আরবী ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’-এর হুবহু বাংলা তর্জমা করিয়া লেখা হইয়াছিল : পরম করুণাময় আল্লাহর নামে হলফ করিয়া আমি অঙ্গীকার করিতেছি যে আমাদের নির্বাচনী ওয়াদা ছয় দফা অনুসারে শাসনতান্ত্রিক সংবিধান রচনা করিব।” (আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, খোশরোজ কিতাব মহল, বাংলাবাজার, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৫৪১)

মযহারুল ইসলামের লেখায় ওই হলফনামার বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে আছে, ‘আমরা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ শপথ গ্রহণ করিতেছি পরম করুণাময় ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলার নামে…।’ (মযহারুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা ৬৫১) এভাবেই বঙ্গবন্ধুর লেখা, ব্যক্তিগত কথা ও ভাষণে ঈমানদীপ্ত নানা প্রসঙ্গ বিদ্যমান।

 

লেখক : ধর্ম বিভাগীয় প্রধান, কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x