ঢাকা, রবিবার ১৯ মে ২০২৪, ০৩:৪৭ অপরাহ্ন
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোড়ল আব্দুস সালামের ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
মোঃ মনিরুল ইসলাম, পাইকগাছা(খুলনা)

১৯৬২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত  প্রায় ৫০ বছর ব্যাপী বৃহত্তর খুলনাসহ সন্নিহিত জেলা সমূহে যে সকল রাজনৈতিক কর্মী, সংগঠক ও নেতা সর্বোচ্চ ত্যাগ, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন এবং স্বপ্ন দেখিয়েছেন মোড়ল আব্দুস সালাম তাদের মধ্যে অন্যতম।  ১৯৪৮ সালের ১ এপ্রিল সাতক্ষীরা জেলার তালা থানার কৃষ্ণকাঠি গ্রামে তার জন্ম। পিতা আবুল কাশেম মোড়লের কঠোর শাসন আর মা আশরাফুন্নেছা বেগমের অকৃত্রিম ভালোবাসার মধ্য দিয়ে কৃষ্ণকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক পাঠ শেষ করে কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দিরে ভর্তি হন মোড়ল আব্দুস সালাম। এই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। স্কুলে সিনিয়র সহকারী শিক্ষক শেখ মফেজউদ্দীনের অনুপ্রেরণা এবং নিজের সহজাত প্রতিবাদী ভূমিকার কারণে লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন তিনি। মফেজউদ্দীন স্যারের প্রস্তাবে ১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর শিক্ষা আন্দোলনে শহীদ ছাত্রনেতা মোস্তফা, বাবলু ও ওয়াজিউল্ল্যার হত্যার প্রতিবাদে কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দিরের ছাত্রদের ক্লাস বর্জন, ছাত্র ধর্মঘট, স্কুল থেকে কপিলমুনি বাজারের প্রধান সড়কে আইয়ুব বিরোধী স্লোগান এবং ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে মিছিল করে অবশেষে কপিলমুনি ইউনিয়ন কাউন্সিল প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন এবং নেতৃত্ব দেন মোড়ল আব্দুস সালাম।

এই আন্দোলনই ছিল কপিলমুনি ও সন্নিহিত এলাকায় প্রথম আয়ুবী স্বৈরশাসন-বিরোধী জাতীয় আন্দোলনের সূচনা। এরপর ১৯৬৪ সালে বি, এল, কলেজের তৎকালীন ভি, পি, মিয়া সাদিকুর রহমান এবং খুলনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি কাজী ওহেদুজ্জামান কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির স্কুল শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্ব প্রদান করেন আবদুস সালামের উপর। ১১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির সম্পাদক থাকেন শেখ আনোয়ার হোসেন। শুরু হয় মোড়ল আব্দুস সালামের প্রগতিশীল রাজনৈতিক চর্চা আর অনুশীলন। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রভাব পড়ে তার জীবনে। ১৯৬৫ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে ১৯৬৬ সালে বি, এল, কলেজে অধ্যায়নরত অবস্থায় নিজের মামা তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল করিমের প্রভাবে ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত হন আব্দুস সালাম এবং নিজের দক্ষতায় কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সাংগঠনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক প্রয়োজনে তিনি ১৯৬৮ সালে বাগেরহাট পি, সি, কলেজে ভর্তি হন এবং দুই বৎসর বাগেরহাট মহাকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। দেশের রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থায় চারণের মত খুলনা বাগেরহাট এলাকায় তার সাংগঠনিক তৎপরতা অব্যাহত থাকে। বাগেরহাট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি বাগেরহাটের সব কয়টি থানায় ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলেন। যে সব ছাত্রদের সাথে তার প্রাথমিক যোগাযোগ গড়ে ওঠে এবং বিভিন্নভাবে সহযোগিতা পান তার মধ্যে খলিল গাজী, আব্দুল মান্নান, বোরহান, আফজাল হোসেন, জলিল সরদার, আবুল কালাম আজাদ বাকি, জাফর, সৈয়দ তোসাররফ, রুহুল, সাহেব ভাই, এনায়েত প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এরা প্রত্যেকেই ছিলেন মোড়ল আব্দুস সালামের সমসাময়িক। এরপর আমিরুজ্জামান বাচ্চু, জাহাঙ্গীর, ফারুক, অশোক দেবনাথ, আসাদ সহ অনেকেই নতুন কর্মী হিসেবে তার সান্নিধ্যে আসেন। থানা পর্যায়ে এইসব নতুন কর্মীরা আব্দুস সালামের সাথে প্রায়ই থাকতেন। এছাড়াও ফাইলার গোলাম কিবরিয়া, মোড়লগঞ্জের ভি, পি, মোশারেফ, মোসলেম, রতন মিস্ত্রি, রামপালের মহাসীন মোংলার কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তার পিতা আওয়ামী লীগ করতেন এবং পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক। কবি রুদ্র মুহাম্মদের বাড়ি ছিল আব্দুস সালাম এর অন্যতম আস্তানা। চিতলমারীর কালিদাস বড়াল, ফকিরহাটের কেরামত, ওদুদ, শরীফ, মোজাফফার ঝনঝণে গ্রামের আবু ভাই, পেড়ীখালির মোজাহার ভাই, মোল্লাহাটের লায়েক ভাই, আব্দুস সালামের সাংগঠনিক কাজে সম্ভব্য সহযোগিতা করতেন। সারা বাগেরহাট এলাকায় সাংগঠনিক বিস্তৃতির সাথে সাথে জাতীয় রাজনীতিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার খবরের ক্ষোভ-বিক্ষোভে মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠতে থাকে। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ছাত্রনেতা আসাদ। সারাদেশের মতো বাগেরহাটে আন্দোলনের সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।

২৪ জানুয়ারী দশম শ্রেণীর ছাত্র মতিয়ুরের মৃত্যু আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বাগেরহাটসহ সারাদেশ। আব্দুস সালামের নেতৃত্বে বাগেরহাটের সর্বদলীয় ছাত্রনেতৃবৃন্দ আলোচনায় বসে ঘোষণা দেন ১ ফেব্রুয়ারি সারা বাগেরহাট হরতাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও মিছিল। জানা গেল সরকার পক্ষ কঠোরভাবে প্রতিহত করবে আন্দোলন কর্মসূচি। ১ ফেব্রুয়ারি পূর্বরাত্রি সরকারি ঘোষণায় প্রচার হলো সমস্ত বাগেরহাট শহরে কারফিউ। এ, ডি, সি জেনারেল কাউথ খুলনা থেকে বাগেরহাট এসেছেন। তিনি নিজে থেকে হরতাল মিছিল প্রতিহত করবেন। এ সংবাদ সারা বাগেরহাটে প্রচার হওয়ার সাথে সাথে উত্তেজনার মাত্রা বেড়ে গেল। সারা শহরে থমথমে অবস্থা। রাত পার হয়ে সকাল হলো। আব্দুস সালামের নেতৃত্বে কলেজ প্রাঙ্গন থেকে সকাল ১১ টায় শুরু হল মিছিল। আয়ুব শাহীর পতনই ছিল একমাত্র স্লোগান। কলেজ সীমানা পেরিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের পূর্বে ছোট ব্রিজ পার হতেই সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল পুলিশ মিলিটারিসহ এ, ডি, সি কাউথ নিজে। কিছুতেই তিনি মিছিল নিয়ে সামনে যেতে দিবেন না ছাত্ররাও পিছু হটবে না। শুরু হলো লাঠিপেটা টিয়ার গ্যাস সেল আক্রমণ, গুলি। চারিদিকে লাঠিপেটা, টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়া রাইফেলের গুলির আওয়াজ মিলে একটি যুদ্ধক্ষেত্র বলা যায়।একদিকে পুলিশ মিলিটারি অন্যদিকে নিরস্ত্র ছাত্রসমাজ। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে চলল দুইপক্ষের সংগ্রাম ও সংঘর্ষ। আহত হলো ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি জাফর ছাত্র ইউনিয়নের গিয়াস। ঘটনাস্থল থেকে বন্দী হলেন আবদুস সালাম সহ আরো ৪০ জন। আব্দুস সালামসহ বন্দীদেরকে নেওয়া হলো বাগেরহাট জেলখানায়। এর মধ্যে শহর থেকে ন্যাপ নেতা গোরাই দা, রশিদ মোল্লাসহ অনেকে এলেন খাবার-দাবার নিয়ে। শুরু হলো আব্দুস সালামের জেল জীবন। প্রায় এক মাস কারাবাসের পর আন্দোলনের মুখে ২১শে ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান তিনি। কারামুক্তির চেতনায় জাতীয় মুক্তির পথ খোঁজার নতুন তাগিদ অনুভব করেন আবদুস সালাম। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং তা রদের আন্দোলনসহ ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসের মধ্যে বাঙালির গৌরবময় স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিক ইতিহাস অধ্যয়ন ও চর্চার পাশাপাশি সাংগঠনিক কাজে নিরলসভাবে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন তিনি। ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ছাত্রলীগের জাতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য নিরূপণে ছাত্রলীগ আহুত কেন্দ্রীয় বর্ধিত ফোরামের ঢাকা বলাকা ভবন কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে তৎকালীন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক স্বপন কুমার চৌধুরীর প্রস্তাবে সমর্থন দিয়ে নতুন রাজনৈতিক নির্দেশনা খুঁজে পান তিনি। ১৯৭০ সালের ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসকে বাংলাদেশ দিবস হিসেবে পালনের কর্মসূচিতে তৎকালীন পাইকগাছা আশাশুনি এলাকার পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্য এম, এ, গফুরসহ নেতৃবৃন্দের সাথে আশাশুনি, বড়দল, কাটাখালী, রাড়ুলী, কপিলমুনি সহ খুলনা-সাতক্ষীরার ব্যাপক এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বক্তব্য ও সাংগঠনিক কাজ পরিচালনা করেন মোড়ল আব্দুস সালাম।  কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নির্দেশনায় ২৬শে মার্চ খরিহাটির জনসভা বাতিল করে সাতক্ষীরা সদরে পৌঁছে ছাত্রনেতা মোস্তাফিজ, কামরুল, আজিবর, ময়না, জজ, মাছুদ, কামরুচ্ছামা, এনামুল, দুলু, মোস্তাক, দুই খসরু, কাজল, ডাবলু, গোলাম, সুভাষ, সাইদার সহ সাতক্ষীরার ছাত্রনেতাদের প্রয়োজনীয় কাজের প্রস্তুতিতে নির্দেশনা প্রদান করেন। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ২৯শে মার্চ সাতক্ষীরার তৎকালীন এস, ডি, ও খালেদ মাহমুদের অফিসের সামনে হাজির হয়ে মোড়ল আব্দুস সালামের নেতৃত্বে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা নামিয়ে তা পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। গণপরিষদ সদস্য এম, এ গফুর এবং সুবেদার আইয়ুব আলী সহ সাতক্ষীরা জেলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহায়তায় এই কুখ্যাত পাঞ্জাবী খালেদ মাহমুদকে গ্রেফতার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মোড়ল আব্দুস সালাম।

দেশমাতৃকার শৃংখল ভাঙার দুর্বার শপথে বলীয়ান মোড়ল আব্দুস সালামের চেতনায় প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের দৃপ্ত মশাল দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে। স্বপ্নের প্রিয় স্বাধীন দেশের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ পরিচালনায় অর্থের প্রয়োজনে সাতক্ষীরাস্থ পাকিস্তান ন্যাশনাল ব্যাংকের অর্থ ও সম্পদ সংগ্রহ করার পরিকল্পনায় ১৯শে এপ্রিল অভিযানে অংশগ্রহণ করেন মোড়ল আব্দুস সালাম সংগৃহীত হয় ১ কোটি ৮২ লক্ষ টাকা যা ছিল নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক অগ্রযাত্রার শুভ সূচনা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ব্যাপক গণসংযোগ এবং সাংগঠনিক কাজের মধ্য দিয়ে অতঃপর মাতৃভূমি প্রিয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন যোদ্ধা হিসেবে ভারতের দেরাদুন ক্যাম্প থেকে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে ১৯৭১ সালের ১৫ই আগস্ট বৃহত্তর খুলনা জেলা মুজিব বাহিনী প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে ১৮ জন প্রশিক্ষিত এবং ১৯ জন সহযোগী মোট ৩৭ জনের একটি দল নিয়ে ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে সাতক্ষীরা জেলার মাগুরায় অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার ঘাঁটি গড়ে তোলেন তিনি। আব্দুস সালাম শুরু করেন স্থানীয় মানুষের মধ্যে ট্রেনিং প্রধানের কাজ এবং পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর শত্রু ঘাঁটি আক্রমণের পরিকল্পনা। প্রস্তুতিপর্বে প্রাথমিক আক্রমণ পরিচালনায় পাইকগাছা ও আড়াআড়িয়ায় সফলতা অর্জিত হয়। এরপর পাটকেলঘাটা ও কপিলমুনি রাজাকার ঘাটির বিরুদ্ধে আক্রমণ কোনটি আগে পরিচালিত হবে সেই প্রশ্নে মোড়ল আব্দুস সালাম সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তার ভাষ্যমতে প্রথম কপিলমুনি রাজাকার ঘাটি আক্রমণ ও সফলতা অর্জিত হয় ৭ই ডিসেম্বর মঙ্গলবার। এই যুদ্ধ সম্পর্কে মোড়ল আব্দুস সালাম লিখেছেন তার জীবনে “কপিলমুনির যুদ্ধই শেষ যুদ্ধ, কপিলমুনির যুদ্ধই সেরা যুদ্ধ।” এই কপিলমুনি রাজাকার ঘাটির রাজাকারেরা তাদের সংরক্ষিত তালিকা মতে ১৬০১ জন মানুষকে হত্যা করে। কপিলমুনির বিজয় অর্জিত হওয়ার পর গঠিত গণআদালতের রায় বন্দী ১৫৫ জন রাজাকারের মধ্যে ১৫১ জনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। কপিলমুনি যুদ্ধের পর পর্যায়ক্রমে খুলনা ও ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান বিজয় অর্জনে মোড়ল আব্দুস সালাম একজন নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক ও নেতার দায়িত্ব পালন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তালা থানা মুজিব বাহিনী প্রধান ও পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে তিনি খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসাবে খুলনার ছাত্র আন্দোলন পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই সময় খুলনা জেলা ছাত্রলীগের এক গুরুত্বপূর্ণ সভায় মোড়ল আব্দুস সালাম তার বিখ্যাত ঘোষণা”যাদের জন্য ঘর ছেড়েছি, যাদের জন্য পথে নেমেছি, সেই পথের মানুষের ঘরের ঠিকানা না দিয়ে ঐ ঘরে আর আমি ফিরে যাব না” প্রদান করেন।

পরবর্তীকালে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ১৯৭২ সালের ৩১শে অক্টোবর জাসদ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৭৪ সালে খুলনাসহ দক্ষিণ বাংলার আঞ্চলিক গণবাহিনীর প্রধান ও দলের কেন্দ্রীয় অর্গানাইজিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।”শ্রেণী সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করিয়া সফল সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা” তথা সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবী রাজনীতি চর্চায় বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার কাজে আবারো ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়ে ১৯৭৫ সালের ২রা অক্টোবর গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘ কারাবাসের পর ১৯৭৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর মুক্তি পান মোড়ল আব্দুস সালাম। বিপ্লবী দল গড়ে তোলার আদর্শগত সংগ্রামের একপর্যায়ে ১৯৮০ সালের ৭ই নভেম্বর বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ গঠনের জন্মলগ্নে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে ১৯৮৪ সালে সংস্কারমুখী কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নতুনভাবে জাসদের সাথে যুক্ত হয়ে খুলনা জেলা জাসদের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি দায়িত্ব পালন করেন।

সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতার বাইরে তিনি কপিলমুনি রাসবিহারী সংগীত নিকেতন, কপিলমুনি পাবলিক লাইব্রেরী, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি, কপিলমুনি ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ পানি কমিটি, ভূমি কমিটি, রথখোলা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, বিনোদ স্মৃতি সংসদসহ বহু প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন।  ২০১১ সালের ৫ জুলাই দুপুর ২:৪০ মিনিটে ক্ষণজন্মা এই বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজনীতিক ও গবেষক মোড়ল আব্দুস সালাম আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে কপিলমুনি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি বৃদ্ধামাতা, দুই ভাই, চার বোন ও এক স্ত্রী আফসা সালাম ও কন্যা অর্পিতা উম্মীকে রেখে যান। তার মৃত্যুর পর জানাজা শেষে বৃহত্তর খুলনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা অভিভাবক ও বিশিষ্ট রাজনীতিক কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে কপিলমুনিতে গঠিত হয় মোড়ল আব্দুস সালাম কল্যাণ ট্রাস্ট। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির সমন্বয়ে তাঁর একান্ত সহযোগী বিপ্লব কান্তি মণ্ডলের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বিপ্লবী সালাম স্মৃতি পরিষদ। কপিলমুনি মেহেরুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম মিলনায়তন, তালা উপজেলা সদরে বীরমুক্তিযোদ্ধা মোড়ল আব্দুস সালাম গণগ্রন্থাগার, কপিলমুনি খেয়াঘাট থেকে জেঠুয়া বাজার পর্যন্ত সাত কিলোমিটার দীর্ঘ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম সড়ক নির্মিত হয়।

3 responses to “বীর মুক্তিযোদ্ধা মোড়ল আব্দুস সালামের ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ”

  1. … [Trackback]

    […] Find More Info here on that Topic: doinikdak.com/news/32812 […]

  2. visit here says:

    … [Trackback]

    […] Read More on that Topic: doinikdak.com/news/32812 […]

  3. … [Trackback]

    […] Read More on to that Topic: doinikdak.com/news/32812 […]

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x