ঢাকা, রবিবার ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৩৭ পূর্বাহ্ন
হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার প্রকৃতির কারিগর বাবুই পাখি
আব্দুল মুমিন, রূপগঞ্জ

বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, কুঁড়ে ঘরে থাকি কর শিল্পের বড়াই/ আামি থাকি মহা সুখে অট্টালিকা পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে/ বাবুই হাসিয়া কহে সন্দেহ কি তাই/ কষ্ট পাই তবু থাকি নিজেরই বাসায়। কবি রজনীকান্ত সেনের এ কবিতাটি আজো মানুষের মুখে। অথচ বাবুই পাখির অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে বাবুই পাখি ও বাবুই পাখির বাসা। এসব বাসা শুধু শৈল্পিক নিদর্শনই ছিল না, মানুষের মনে চিন্তার খোরাক জোগাত এবং স্বাবলম্বী হতে উৎসাহ যোগাত, কিন্তু কালের বিবর্তনে ও পরিবেশে বিপর্যয়ের কারণে আজ এ পাখিটি আমরা হারাতে বসেছি। সেই বাসা দেখতে যেমন আকর্ষনীয় তেমন মজবুত। এরা বিভিন্ন গাছে বাসা বাঁধলেও তালগাছেই বাসা বাঁধে বেশি। অথচ সেই তালগাছও এখন বিপন্ন প্রায়।

উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের কামশাইর এলাকার ডা. আক্তার হোসেন বলেন, বাবুই পাখি আসলে প্রাকৃতির দর্জি। এর বুননে সত্যি জাদু আছে। যে কেহ বাবুই পাখির বাসা বুনন দেখে মুহিত হয়ে যান। এছাড়া এ পাখি শিল্পের নির্দশনও বটে। একে দেখে আমাদেরও শিক্ষার অনেক কিছু আছে। ফসলের জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ, যানবাহনের শব্দ, বিল এলাকায় মৎস্য চাষ, তালগাছ না থাকা সর্বোপরি স্বাভাবিক বিচরণ ক্ষেত্র কমে যাওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির কারিগর বলে খ্যাত বাবুই পাখি। গ্রাম বাংলায় এখন আর আগের মতো বাবুই পাখির সেই শৈল্পিক বাসা চোখে পড়ে না। জানা যায়, কালের বির্বতনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে আজ আমরা হারাতে বসেছি সেই কারিগর বাবুই পাখির শিল্প কর্মকে। গাছে গাছে জগের মতো চমৎকার বাসা তৈরি করায় এ পাখি কারিগর পাখি নামে পরিচিত।

অনেকে একে তাঁতি পাখিও বলেন। কেউ আবার দর্জি পাখিও বলেন। কথিত আছে বাবুই পাখি রাতে বেলায় ঘর আলোকিত করার জন্যে জোনাকি পোকা ধরে নিয়ে বাসায় রাখে এবং সকাল হলে আবার তাদের ছেড়ে দেয়। জানা যায়, প্রায় ১৫-২০ বছর আগে গ্রামগঞ্জের তাল, নারিকেল, খেজুর ও সুপারি গাছে প্রচুর বাবুই পাখির বাসা চোখে পড়ত। বাবুই পাখির এসব বাসা শুধুমাত্র শৈল্পিক নির্দশনই ছিল না, মানুষের মনে চিন্তার খোরাকও জোগাত। বাবুই পাখির বাসা যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি মজবুত।প্রবল ঝড়বাতাসেও টিকে থাকে তাদের বাসা। খড়ের, ধানের পাতা, তালের কচিপাতা, ঝাউ ঘাস, আখের পাতা ও কাঁশবনের লতাপাতা দিয়ে উঁচু নারিকেল, সুপারি ও তালগাছে চমৎকার আকৃতির বাসা তৈরি করত বাবুই পাখিরা। গুচ্ছগ্রামের মতো এক সাথে দলবেঁধে বাস করত বাবুই পাখিরা। একাধারে স্থপতি, শিল্পী এবং সামাজিক বন্ধনেরও প্রতিচ্ছবি। বাবুই পাখি তাদের বাসা এত মজবুত ও শক্তিশালীভাবে তৈরি করে যে এ বাসা টেনেও ছেঁড়া কঠিন।

এরা এক বাসা থেকে আরেক বাসায় যায় পছন্দের সঙ্গী খুঁজতে। বাবুই সাধারণত দুই ধরনের বাসা তৈরি করে থাকে। স্ত্রী বাবুই পাখির প্রেরনা পেয়ে পুরুষ বাবুই পাখি খুবই শৈল্পিকভাবে এসব বাসা তৈরি করে থাকে। একটা বাসা তৈরি করতে তাদের ১০/১২ দিন লেগে যায়। রূপগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার মাহবুবা ফেরদৌসী বলেন, এমন একটা সময় ছিল যখন গ্রামাঞ্চলে প্রচুর তাল, নারিকেল ও খেজুর গাছ দেখা যেতো। বাবুই পাখির কিচিরমিচির শব্দ এবং তাদের শৈল্পিক বাসা তৈরি মানুষকে আনন্দিত করতো। কিন্তু এখন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে গ্রামে।

জলাশয়সহ কৃষি জমি বালু ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। গাছপালা কেটে বসতির জন্যে অট্টালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তাই এখন আর আগের মতো গ্রামাঞ্চলের রাস্তার ধারে, বাড়ির পাশে ও পুকুর পাড়ে সেই তালগাছ, খেজুর গাছ যেমন দেখা যায় না তেমনি দেখা মিলে না শৈল্পিক বাবুই পাখিরও। গ্রামের মাঠের ধারে, পুকুর পাড়ে কিংবা নদীর তীরে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে শৈল্পিক বাবুই পাখিও। এখন এসব যেন বইয়ের ছড়া আর দাদুর কাছে শোনা গল্প। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করা এবং বড় বড় তাল, খেঁজুর, নারিকেল গাছ না থাকার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির কারিগর বাবুই পাখি। তাই বাবুই পাখি ও এর শৈল্পিক নিদর্শন রক্ষা করার জন্যে দ্রæত সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহন করা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.