সারসংক্ষেপ : বাংলা লোকসাহিত্য ভান্ডারে পালা বা গাথা উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। মূলত লোককাহিনী এবং গাথা সংগ্রহের মধ্যদিয়েই ফোকলোর চর্চার সূত্রপাত ঘটে। ধীরে ধীরে ফোকলোরের পরিধি এখন ব্যপক বিস্তৃত। প্রথমে ফোকলোর চর্চা আমেরিকা, জার্মানে শুরু হয়েছে ঠিকই কিন্তু বাংলাদেশও বসে নেই। বাংলাদেশকে পালা বা গাথা চর্চার পীঠস্থান বলা চলে। কেননা বাংলাদেশ হল খাল-বিল-হাওর-জঙ্গলে ভরা ব-দ্বীপ অঞ্চল। এখানকার মানুষের অবসর সময় বেশি। এই অবসরে বাঙ্গালি মেতে উঠে সমকালীন জীবন স্পর্শ করা নানা পালা গানের চর্চায়। তাই একসময় সৃষ্টি হয় নানা পালাকার। যিনি মর্ম স্পর্শ করা কিংবা বীরত্ব ব্যঞ্জক নানা ঘটনাকে পালা আকারে রূপ দেন । সৃষ্টি হয় গায়ক। যিনি এই পালাগুলো শ্রোতার সন্মূখে গীত, বাদ্য ও নৃত্য সহযোগে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করেন। দর্শক মোহিত হয় এবং এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের মাধ্যমে পালাগুলো বেঁচে থাকে। ফোকলোর সাধক ড. দীনেশচন্দ্র সেন ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ত্রিপুরা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বৈচিত্রময় কাহিনীর পালা সংগ্রাহক দ্বারা সংগ্রহ করেন। ১৯২৩ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে ইংরেজি বাংলা মিলে মোট আট খন্ড সম্পাদিত করে পালাগুলো গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করেন। প্রকাশিত প্রথম খন্ড অর্থাৎ ময়মনসিংহ গীতিকায় প্রতিফলিত মাটিঘেঁষা মানুষের জীবনপ্রবাহর চিত্র আংকনের তাগিদেই এই প্রবন্ধের সূত্রপাত।
বাংলা সাহিতের একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ ধারা হলো লোকসাহিত্য। লোকসাহিত্য লোকের সাহিত্য, কোন ব্যষ্টির রচনা হলেও সেটা হয়ে যায় সমষ্টির। মূল রচনার মধ্যে ব্যক্তি বিলীন হয়ে যায়। গীতিকাগুলো ঠিক তেমনি ভাবে রচিত এবং প্রচারিত। লোক জীবনে বসবাসকারী রচয়িতা লোক জীবন স্পর্শি নানা ঘটনার মালা গেঁথেছেন পালাগুলোর মধ্যে। বাংলা গীতিকাকে মোট তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় যথাঃ ক) নাথ গীতিকা খ) ময়মনসিংহ গীতিকা গ) পূর্ববঙ্গ গীতিকা। ময়মনসিংহ গীতিকায় ঐ অঞ্চলের মোট দশটি পালা সংযোজিত হয়েছে। পালাগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করেছেন চন্দ্রকুমার দে। পালা সংগ্রাহক হিসাবে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। এছাড়া ক্ষিতীশ চন্দ্র মৌলিক নিজ প্রচেষ্টায় গ্রামে গ্রামে ঘুুরে অনেক পালা সংগ্রহ করেন এবং ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে মোট সাত খন্ডে সেগুলি প্রকাশ করেন। দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত “মৈমনসিংহ গীতিকা” ও “পূর্ববঙ্গ গীতিকা” থেকে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে উক্ত লেখকের সম্পাদিত গীতিকায়। তবে পালাগুলো প্রথম প্রকাশ করে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন ড. দীনেশ চন্দ্র সেন। এ প্রসঙ্গে ড. আশরাফ সিদ্দিকী বলেন,
‘তবে এ কথা নিশ্চিত যে ড.দীনেশচন্দ্র আমাদের হারানো গীতিকা সম্পদকে উদ্ধার করে ইংরেজী অনুবাদের মাধ্যমে বিশের দশক থেকেই বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষন করে দেশকে বিশ্ববরেণ্য করে তুলেন। ক্ষিতিশ মৌলিক অসম্পূর্ন পালাগুলিকে পুর্ণতা দিয়ে তাদের আরও নির্ভরযোগ্য করে গীতিকা সাহিত্যকে বিজ্ঞান ভিত্তিকই নয় শুধু , এ দিগন্তে যে এখনও কাজ করার প্রচুর সুযোগ আছে তার প্রতিও অঙ্গুলি সংকেত করে গেছেন।’
তাই পালাগুলো নিছক গান বা নাট্যাভিনয় নয়, এগুলোর সাথে মিশে আছে লোক হৃদয়ের নানা অব্যক্ত কথা। অনেকে মনে করেন গীতিকাগুলোতে আদিম জীবনের প্রতিচ্ছবির পরিস্ফুটন ঘটেছে। আদিম জীবন এবং লোকজীবন এক নয়। তবে আদিমজীবনের বিবর্তনের ফলে লোকজীবনের উদ্ভব। মৌখিকভাবে ও বংশপরম্পরায় স্বীয় ঐতিহ্যকে লালন পালন করে লোকমানুষ। সর্বোপরি বলাযায় যে, লোক মানুষের সামগ্রিক জীবনাচরন প্রস্ফুটিত হয়েছে পালাগুলোর ছত্রেছত্রে। এ কারনে পালাগুলো মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছে এবং আলোড়িত হয়েছে।
জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি মানুষের বেঁচে থাকাটাই হল মানব জীবন। মানুষের এই জীবন কাটে নানা বৈচিত্রতার মধ্য দিয়ে। সুখ-দূঃখ, আশা-নিরাশা, পাওয়া-না পাওয়ার মধ্য দিয়ে জীবন ছুটে চলে অগ্রপথে। আবার সেই মানুষ যখন গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বসবাস করে তখন একটা সামগ্রিক জীবন চিত্র প্রতিফলিত হয়। যেখানে সমগ্র মানুষের বাঁচা মরার দৃশ্য চিত্রিত হয়। যা দেখে আমরা অনুধাবন করতে পারি সেই মানুষগুলোর জীবন যাপন পদ্ধতি, আচার-বিশ্বাস-সংস্কার ইত্যাদি সম্বন্ধে। কিন্তু লোকজীবন বলতে আমরা কি বুঝবো? অর্থাৎ লোক আমরা কাদের বলবো? ‘লোক’ শব্দের ইংরেজী প্রতিশব্দ হল ‘ফোক’। আর এই ফোক শব্দ নিয়ে শুরু হয়েছে নানা মতানৈক্য। কেউ বলেছেন গ্রামের সাধারন মানুষই ফোক। আবার কেউ বলেছেন ‘লোক’ গ্রাম-শহর, সাধারন বা অসাধারন ভাবে জীবন যাপন করতে পারে৷ আমেরিকার সমাজবিজ্ঞানীগণ মৌলিক সংস্কৃতির অধিকারী মানবগোষ্ঠীকে বোঝানোর জন্য এই শব্দ অনেক সময় ব্যবহার করে থাকেন।মূলত লোক বলতে আমরা তাদেরকেই বুঝবো যারা গোষ্ঠী চেতনায় উদ্বুদ্ধ এবং সংহত সমাজে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ। যারা মৌলিক সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। ময়মনসিংহ গীতিকায় এইসব মানুষদের জীবনাচরণ ফুটে উঠেছে। কেননা লোককবি এই মানুষদের সমাজেই বসবাসকারী মানুষ। সংগ্রাহক লোককবির নিকট থেকে লোকজীবনের খবর সংগ্রহ করেছেন এবং সম্পাদক সেগুলো গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে বিশ্বে সেই বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। যা লোকজীবনচিত্রের দলিল স্বরূপ ময়মনসিংহ গীতিকার প্রতিটি পাতায় পুঞ্জিভুত। এবার সেদিকের পানে দৃষ্টি দেয়া যাক।
ময়মনসিংহ গীতিকায় যে দশটি পালা স্থান পায় সেগুলি হলো- মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কমলা, দেওয়ান ভাবনা, দস্যু কেনারাম পালা, রূপবতী, কঙ্ক ও লীলা, কাজলরেখা, দেওয়ানা মদিনা। ময়মনসিংহ গীতিকার পালাগুলো মূলত প্রেম-বিরহকে কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। প্রেমকে কেন্দ্র করে কাহিনী অন্তিমের পথে ধাবিত হয়েছে। আর এই প্রেমের বর্ণনা করতে গিয়ে লোক কবি লোকজীবনের নানা বাস্তব অবাস্তব চিত্রের সংযোজন ঘটিয়েছেন। যাতে কাহিনী লোকজীবন স্পর্শী রূপ পরিগ্রহ করেছে। শুরুতেই মহুয়া পালা চিত্রিত হয়েছে। মহুয়া একটি ফুলের নাম। যে ফুলের সৌরভে মাদকতা বর্তমান। কবি দ্বীজ কানাই প্রণীত মহুয়া পালায় মহুয়া একটি জ্যান্তফুল। যে ফুলের সৌন্দর্যে নদের চাঁদ পাগল। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে নদের চাঁদ ও মহুয়ার মিলন হয়। তবে সে মিলন প্রতিষ্ঠিত হয় মৃত্যুর পর অন্ধকার কবরে।
মহুয়া পালার বন্দনা অংশে লোকজীবনের অসাম্প্রদায়ীক চেতনার বহিঃপ্রকাশ আমরা লক্ষ করি। যেখানে কোন নির্দিষ্ট ধর্ম সম্প্রদায় বড় হয়ে উঠেনি। কেননা লোকজীবনে বসবাসকারী মানুষ অন্ধ ধর্ম চেতনাকে ছাপিয়ে রেখে সবসময় উর্দ্ধে অবস্থান করেছেন। তাই পালাগুলো ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে গীত হয়েছে এবং সকল স্তরের শ্রোতামন্ডলী এই পালা দেখে প্রীত হয়েছেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ধর্ম কেন্দ্রিক এবং স্থুলতা নিয়ে গড়ে উঠেছিল। সেদিক থেকে আমাদের গীতিকাগুলো ছিল ধর্মীয় প্রভাব মুক্ত। ময়মনসিংহ গীতিকার পালাগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, লোকজীবন ধর্মের কড়াল ছোবলে মৃত্যুবরণ করেনি। ধর্মকে হৃদয়ে ধারন করে তারা ঐতিহ্যকে লালন করেছেন।
‘উওরে বন্দনা গো করলাম কৈলাস পর্বত।
যেখানে পড়িয়া গো আছে আলীর মালামের পাথ্থর,
পশ্চিমে বন্দনা গো করলাম মক্কা এন স্থান।
উর্দিশে বাড়ায় ছেলাম মমিন মুসলমান,
সভা কইর্যা বইছ ভাইরে ইন্দু মুসলমান।
সভার চরণে আমি জানাইলাম ছেলাম॥’
পৃথিবীতে মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় মৌল উপাদান হল খাদ্য। পেটে ক্ষুধা আছে বলেই আমরা গতিশীল। তাই খাদ্য অন্বেষণ ও জীবনধারনের জন্য মানুষ বেছে নেয় বৈচিত্রময় পেশা। সেসব পেশার মধ্য দিয়ে মানুষ দু’মুঠো অন্ন জোগায় এবং বাঁচার লড়াই করে। মহুয়া পালায় আমরা লোক পেশাকে আশ্রয় করে লোক জীবনধারনের চিত্র দেখতে পাই। যেখানে বেদে পেশাকে সঙ্গিকরে যাযাবর শ্রেণীর একদল মানুষ বাঁচার লড়াইয়ে ব্যস্ত। ‘হুমড়া বাইদ্যা ডাক দিয়া কয় মাইন্কিয়া ওরে ভাই।
খেলা দেখাইবারে চল বৈদেশেতে যাই॥’
লোকজীবন সবসময়ই অলস এবং আনন্দহীন। লোকমানুষ সারাদিন কাঠফাটা রোদে মাঠে কাজ করে অবসর সময় গল্পগুজবের মাধ্যমে কাটায়। বর্তমানের মত আনন্দ বিনোদনের মাধ্যম তখন ছিলনা। মাঝেমধ্যে তারা লোক উৎসব কিংবা লোক খেলার মধ্যে দিয়ে আনন্দ উপভোগ করত। মহুয়া পালায় হুমরা বাইদ্যার দল যখন ঠাকুর বাড়ি তামাশার আসর বসায় তখন লোকজীবনের বিনোদন তৃষ্ণার চিত্র অনায়াসে চিত্রিত হয়।
‘যখন নাকি হুমরা বাইদ্যা ডুলে মাইলো বাড়ী।
নদ্যাপুরের যত মানুষ লাগল দৌড়াদৌড়ি৷
একজনে ডাক দিয়ে কয়রে আর এক জনের ঠাঁই।
ঠাকুর বাড়ী বাইদ্যার তামসা চল দেইখ্যা আই॥’
মহুয়া পালাটি মূলত মহুয়া ও নদের চাঁদের প্রেমকে কেন্দ্র করে সামনে ধাবিত হয়েছে। ঠাকুর বাড়ীর সাপের খেলা দেখাতে গিয়ে মহুয়া নদের চাঁদের চোখে ধরা পড়ে। শুধু নদের চাঁদই নয়, মহুয়াও নদের চাঁদকে গোপনে স্বীয় মনে ঠাঁই দেয়। দুজনের প্রেমাসক্ত মনের আকুতি প্রকাশের জন্য পুকুর ঘাটকে বেছে নেয়। যদিও বা এটা লোক কবির কৌশল। তবে এখান থেকে আমরা বুঝতে পারি লোকজীবনের প্রেম ও জলের ঘাটের একটা নিগূঢ় সম্মন্ধ রয়েছে। বর্তমানের মত বোটানিক্যাল গার্ডেন কিংবা চাইনিজ প্রেমে লোকজীবন অভ্যস্থ নয়। কেননা লোকজীবনের প্রেম বাস্তব প্রেম। যেখানে নাই কোন স্বার্থ, আছে শুধু দুজনের একে অপরকে পাওয়ার আকুতি। আর যে আকুতি প্রকাশ পেয়েছে জলের ঘাটে নানা বুদ্ধিদীপ্ত উপমার মাধ্যমে।
‘লজ্জা নাই নির্লজ্জ ঠাকুর লজ্জা নাইরে তর।
গলায় কলসী বাইন্দা জলে ডুব্যা মর॥
কোথায় পাব কলসী কইন্যা কোথায় পাব দড়ী।
তুমি হও গহীন গাঙ্গ আমি ডুব্যা মরি॥’
ময়মনসিংহ গীতিকায় লোকজীবনের প্রেম অসাধারণ ভাবে ফুটে উঠেছে। ছায়া শীতল গ্রামের পুকুরঘাটেই প্রেমের সূচনা হয়েছে। মহুয়া ও নদের চাঁদের মত মলুয়া পালায় চাঁদ বিনোদ ও মলুয়ার প্রেমও পুকুরঘাটে সূত্রপাত হয়েছে। চন্দ্রাবতী পালায় জয়ানন্দ ও চন্দাবতীর প্রেম ফুল বাগীচায় শুরু হলেও জয়ানন্দ পরনারী আসক্ত হয়। আসক্তির বহি:প্রকাশ ঘটে পুকুরঘাটে গাছের বাকলে প্রেমপত্র লিখার মাধ্যমে। এই কারনে চন্দ্রাবতী পালা মোড় নেয় বিরহের দিকে এবং জলে ডুবে জয়ানন্দের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে কাহিনীর যবনিকা ঘটে।
‘সরমে মরণ আইল কথা কওয়া দায়।
জলের ঘাটে গিয়া নাগর উঁকিজুকি চায়,
লিখিয়া রাখিল পত্র ইজল গাছের মূলে।
এইখানে পড়িব কন্যা নয়ন ফিরাইলে॥’
গ্রামে-গঞ্জে একসময় মানুষ মারা গেলে শোনা যেত ভূত-প্রেত কিংবা জ্বীনে ধরে মারা গেছে। বর্তমানে এগুলো কমই শোনা যায়। চিকিৎসা পদ্ধতি আধুনিক হওয়ার ফলে এখন সঠিক রোগ নির্বাচন করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু একসময় ঝাড়-ফুঁক, মন্ত্র-তন্ত্র, গাছ-গাছড়াই ছিল চিকিৎসার প্রধান উপকরণ। যাকে এখন আমরা লোকচিকিৎসা বলছি। তাই লোকজীবনের নানা অসুখ বিসুখ লোক চিকিৎসার উপরই নির্ভর ছিল। মহুয়া পালায় নদের চাঁদের যখন জ্বর হয় তখন সন্ন্যাসী কর্তৃক চিকিৎসার ধরন ও উপাদান হিসাবে আমরা দেখতে পাই-
‘বনে আছে গাছের পাতা তুইলা দিবাম আমি।
এই গাছে বাঁচিবে তোমার পতির পরাণী৷
দারুণ আকাল্যা জ্বর হাড়ে লাগ্যা আছে।
পরাণে বাঁচিয়া আছে মইরা না সে গেছে৷
শ্বাসেতে ধরিয়া পাতা আন নদীর পানি।
এই মন্ত্রে বাঁচাইব তাহার পরাণি॥’
লোকবিশ্বাস আছে বাড়িতে মেহমান আসা ভাল। কিন্তু মেহমান শুধু আসলেই হলোনা, মেহমানকে আপ্যায়নের বিষয়টাও সংস্কৃতির ভেদে ভিন্নতর। প্রান্ত উত্তরবঙ্গের কোন কোন স্থানে মেহমানকে মিষ্টি ও পান দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। ময়মনসিংহ গীতিকায় মেহমান আপ্যায়নের চিত্র আমরা অবলোকন করি। বসতে দেওয়া থেকে শুরু করে মেহমানের খাতির যত্নের বিবরণও পাওয়া যায়।
‘আমার বাড়ীত যাইওরে বন্ধু বইতে দিয়াম পিরা।
জল পান করিতে দিয়াম সালি ধানের চিরা ৷
সালি ধানের চিরা দিয়াম আরও সবরী কলা।
ঘরে আছে মইষের দইরে বন্ধু খাইবা তিনো বেলা॥’
লোকজীবন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দরিদ্র জীবন। নানা অভাব অনটনের মধ্যদিয়ে লোকজীবন প্রবাহিত। অর্থনৈতিক টানপোড়নের মধ্যদিয়ে জীবন ছুটে চলে অন্তিমের পানে। শোষকের ঋণ শোধ করতে গিয়ে বিনোদের সংসারের কি হাল হয় মলুয়া পালায় অনায়াসে সেই চিত্র চিত্রিত হয়েছে।
‘আছিল হালের গরু বেচিয়া খাইল।
পাঁচ গোটা ক্ষেত বিনোদ মাজনে দিল ৷
খেত খোলা নাই তার, নাই হালের গরু।
না বুনায় ধান কালাই না বুনায় সরু॥’
পূর্বেই বলা হয়েছে লোকজীবন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অর্থ কষ্টের জীবন। বারমাস দূ:খ-কষ্টের ভেতর দিয়ে এ জীবন ছুটেচলে। খেয়ে না খেয়ে কোনমতে বেঁচে থাকাটাই লোকজীবনের মূল লক্ষ্য। শুধুমাত্র বাঁচার তাগিদে গচ্ছিত সম্পদ পর্যন্ত বিনষ্ট করতে হয়। ময়মনসিংহ গীতিকায় দেখা যায় দু’মুঠো অন্নের জন্য বিক্রি করতে হয়েছে নারীর প্রিয় জিনিস অলংকার। এখান থেকে আমরা লোকজীবনে ব্যবহার্য অলংকারের বর্ণনাও পাই। এছাড়া নারীর বারমাসির বর্ননাও পাওয়া যায়।
‘নাকের নথ বেচ্যা মলুয়া আষাঢ় মাস খাইল।
গলায় যে মতির মালা তাও বেচ্যা খাইল ৷
শায়ণমাসেতে মলুয়ার পায়ের খাড়ু বেচে।
এত দুঃখ মলুয়ার কপালেতে আছে ৷
হাতের বাজু বান্ধা দিয়া ভাাদ্রমাস যায়।
পাটের শাড়ী বেচ্যা মলুয়া আশ্বিন মাস খায়॥’
পাহাড়ের গুহাকেই প্রথম মানুষ ঘর হিসাবে ব্যবহার করে। এরপর বিবর্তনের ধারায় তারা বাইরে বেড়িয়ে আসে এবং ঘর তৈরি করে। ধীরে ধীরে মানুষ লোকজীবনে পদার্পণ করে। লোকজীবনে বসবাসকারী মানুষের ঘর-বাড়ির চিত্র আমরা ময়মনসিংহ গীতিকায় দেখতে পাই। সেই উলুছনে ছাওয়া আটচালা চৌচালা ঘর বর্তমান সময়ে দেখা দুস্প্রাপ্য। যেখানে বসবাস করে লোকজীবন অতিবাহিত হয়।
‘আট চালা চৌচালা ঘর বান্ধিয়া সুন্দর।
ভালা কইরা বান্ধে বিনোদ বার-দুয়াইরা ঘর;
শীতল পাটী দিয়া বিনোদ ঘরে দিল বেড়া।
উলুছনে ছাইল চাল দেখতে মনহারা॥’
হরেক রকমের লোকবিশ্বাস লোকজীবনের সাথে জড়িত। নানা বিপদে আপদে লোক মানুষ বিভিন্ন লোকদেবতা, পীর, আওলিয়া, দরবেশের শরণাপন্ন হত। রোগ নিরাময়ের জন্য পশু-পাখি কিংবা সিন্নি মানত করত। মূলত এখান থেকে মাজার সংস্কৃতির প্রচলন ঘটে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শুধু লোকমানুষই নয় উঁচুতলার সম্ভ্রান্ত মানুষরাও মাজার বিশ্বাসী। আমাদের দেশের জাতীয় নির্বাচনে মন্ত্রীদের মাজার জিয়ারত এবং মানতের মাধ্যমে নিবার্চনী প্রচার শুরু করতে দেখা যায়। এই মানত করার মধ্য দিয়ে লোকবিশ্বাসের প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়। ময়মনসিংহ গীতিকায় আমরা দেখতে পাই-
‘জোড়া মইষ দিয়া মায় মানসিক করে।
মায়ত কান্দিয়া কয় পুত্র বুঝি মরে ॥’
লোকজীবন সব সময়ই নানা বিশ্বাস সংস্কারে আবদ্ধ। বাইরে যাওয়ার সময় মাথায় আঘাত পেলে বসে যেতে হয়, এক শালিক পাখি দেখা অশুভ, রাতে কুকুর কাঁদা অশুভ, সন্ধ্যার সময় ঘর থেকে চাল দিলে লক্ষ্মী চলে যায় এমন নানা বিশ্বাস সংস্কার লোকজীবনে প্রচলিত। শুধু লোকজীবন নয় আধুনিক জীবনেও এসব বিশ্বাসের প্রতিফলন দৃষ্টিগোচর হয়। ময়মনসিংহ গীতিকায় আমরা লোক বিশ্বাস-সংস্কারের চিত্র অবলোকন করি।
‘যাইবার কালে হাঁচির শব্দে বাধা যে পড়িল।
কতক্ষণ দুলাল মিঞা বার যে চাহিল৷
তার পরে মেলা দিয়া সামনে দেখে তেলী।
ডাইনেতে দেখিল এক গাভীন শিয়ালী৷
মাথার উপরে ডাকে কাউয়া চিল রইয়া।
নানা অলক্ষণ দেখে পন্থে মেলা দিয়া ॥’
মানুষের নেশার অন্ত নাই। কারো টাকার নেশা, কারো নারীর নেশা, কারো বই পড়া কিংবা গান শোনার নেশা, আবার কারো মাদক গ্রহনের নেশা। উচ্চবিত্ত নিুবিত্ত সবার মাঝেই নেশা বর্তমান। লোকজীবনেও মাদকের নেশা প্রচলিত। কেউ পান খায়, কেউ গুল, গুটকী, চুয়ানি, ভাঙ, গাঁজা ইত্যাদি খায়। ময়মনসিংহ গীতিকায় লোকনেশা তামাক সেবনের বর্ণনা দৃষ্টিগোচর হয়।
‘কিছু কিছু তামুক আর টিক্কা দিল সাথে।
মেলা কইরা বিনোদ বাহির হইল পথে ॥’
কোরমা, পোলাও, বিরিয়ানী এসব খাদ্য তালিকার সাথে লোকজীবনের পরিচয় নাই। বাড়ীর আশেপাশে প্রাপ্ত খাদ্য উপাদান দিয়ে তৈরি বাহারী খাবার লোক মানুষ খেয়ে থাকে। ময়মনসিংহ গীতিকায় লোক খাদ্যের বিবরণ দিতে লোককবি ভুলে যাননি।
‘মানকচু ভাজা আর অম্বল চালিতার।
মাছের সরুয়া রান্ধে জিরার সম্বার ৷
কাইট্টা লইছে কই মাছ চরচরি খারা।
ভালা কইরে রান্ধে বেনুন দিয়া কাল্যাজিরা ৷
একে একে রান্ধে সব বেনুন ছত্রিশ জাতি।
শুকনা মাছ পুইড়া রান্ধে আগল বেসাতি॥’
মানব জীবনের একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ ধাপ হল বিয়ে। বিয়ের মাধ্যমে নারী পুরুষের যৌনতার স্বাধীনতা দেয়া হয়। তাই বাল্যকাল থেকেই বিয়ে নিয়ে মানুষের মধ্যে কৌতুহল কাজ করে। আবার বিয়ে নিয়ে বিভিন্ন সংস্কৃতি বলয়ে নানাধরনের আচার-ক্রিয়া সমপন্ন হয়। বিয়ে একটা শুভ কার্য তাই শুভ দিনের ব্যাপারটিও বিবাহের সাথে জড়িত। আবার শুভ-অশুভ দিন নিয়ে রয়েছে লোক সমাজে নানা বিধি নিষেধ। মলুয়া পালায় আমরা দেখতে পাই-
‘আষাঢ় মাস হীরাধরের আশায় আশে যায়।
বিয়া নাই সে হইল কন্যার কি করি উপায়৷
শায়ন মাসে বিয়া দিতে দেশের মানা আছে।
এই মাসে বিয়া দিয়া বেউলা রাঢ়ি হইছে ৷
ভাদ্র মাসে শাস্ত্র মতে দেবকাযর্য মানা।
এই মাসে না হইল বিয়া কেবল আনাগুনা॥’
নয়নচাঁদ ঘোষ প্রণীত ‘চন্দ্রবতী ’ পালায়ও আমরা লোকজীবনের নানা বিশ্বাস-আচার-সংস্কারের চিত্র দেখতে পাই। মূলত দুই নারী ও এক পুরষের প্রেম নিয়ে চন্দ্রবতী একটি ট্র্যাজিক পালা। প্রেমাখ্যান হলেও লোকজীবন উপেক্ষিত নয়। এ পালায় লোকজীবনে বিয়েকে কেন্দ্র করে কুষ্টি বিচারের চিত্র ধরাপরে। কুষ্টির উপর নির্ভর করে লোকজীবনের ভাল-মন্দ, শুভ-অশুভ, দিন-ক্ষণ ধার্য হয়।
‘করকুষ্টি বিচারিয়া সম্মন্ধ মিলায়।
ভালা করে কন্যা বিয়া দেওয়া বড় দায়৷
কুষ্টি বিচারি কৈল সবর্ব সুলক্ষণ।
বরকন্যার এমন মিল ঘটে কদাচন ৷
কুষ্টিতে মিলিছে ভাল যখন এই বরে।
এই বরে কন্যাদান করিব সুস্থরে ॥’
বিয়েকে ঘিরে যে আনন্দ এখন আর চোখে পড়েনা। একসসয় বিয়ের চার-পাঁচদিন আগে থেকে গীত গাওয়া হত। মূলত নারীরা এ গানের স্রষ্টা এবং গায়ক। সারারাত ধরে এয়োগণ কনেকে মাঝখানে বসিয়ে গান গায় এবং গানের মাধ্যমে হাসি ঠাট্টা করে। আবার বাড়ি-বাড়ি গিয়ে পুত্র বা কন্যার মঙ্গল কামনায় সোহাগ মাগে। তেল, সিঁন্দুর, চাউল, হলুদ ইত্যাদি দিয়ে সোহাগ ডালা সাজিয়ে সোহাগ মাগার দৃশ্য ময়মনসিংহ গীতিকায় দেখা যায়। যা লোকজীবনের বিবাহাচারের স্বরূপ উন্মোচন করে।
‘মাথায় লক্ষ্মীর কুলা অঞ্চলে ঘুড়িয়া।
সোহাগ মাগিল মায়ে বাড়ী বাড়ী গিয়া ৷
উত্তম সাইলের চাউলে পিটালী বাটিয়া ,
বন্দনা করিল আগে তিন আবা দিয়া৷
চিমটিয়া তুলে সবে দুয়ারের মাটী ।
সোহাগের দ্রব্য আনি দেয় কুটি কুটি৷
হলদি চাকি আর তৈল সিন্দুরে।
এরে দিয়া সোহাগ ডালা সাজায় সুবিস্তরে৷
নান্দি মুখ আদি যত শুভ কার্য শেষে।
শুভ লগ্নে হইল পরে বিয়া অবশেষে ॥’
যুগে যুগে মানুষের কল্যাণার্থে নানা ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সবসময়ই এক শ্রেণীর মানুষ ধর্মের দোহাই দিয়ে ব্যবসা করেছে। বর্তমানে যেমন মানুষের পরিচয় মানুষ নয়; ধর্মের নামে নিজ পরিচয় দিতে মানুষ সুখ বোধ করে। ধর্ম মানুষকে এতটাই গ্রাসকরে ফেলেছে যে, এটা নিয়ে রীতিমত রাজনীতি শুরু হয়েছে। এগুলোর সাথে সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক কি সেটা ভাববার বিষয়। ধর্মের নামে ফতোয়া দিয়ে একশ্রেণীর মানুষ সৃষ্টিকর্তার পেয়ারের বান্দা হয়ে সিংহাসনে বসে আছেন। অতীতেও এমনটি ছিল, তবে বর্তমানের মত বিভৎস নয়। মলুয়া পালায় দেখাযায় সুন্দরী নারী ভোগের লিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য কাজীর দেয়া নানা ফতোয়া। মধ্যযুগে মুসলিম শাসন আমলে ‘নজরে মরেচা’ এবং ‘নজরে বেওয়া’ নামে দুটি ফতোয়া প্রচলিত ছিল। নজরে মরেচা হল অমুসলমান কোন ব্যক্তি যদি বিয়ে করে তাহলে তাকে কাফ্ফারা দিতে হত। আবার কোন বিধবাকে ঘরে রাখতে হলে কাফ্ফারা দিতে হত, এর নাম নজরে বেওয়া। যার কারনে বিধবাদের স্বামীর সাথে সহমরণে যেতে হত। তারপরও লোকজীবন থেমে থাকেনি চলেছে অগ্রপথে।
‘বিনোদের উপরে কাজী পরণা জারি করে।
হুকুম লিখিয়া দিল পরনা উপরে ৷
সাদি কইরাছ তুমি গেছে ছয়মাস।
নজর মরেচা রইছে তোমার অপরকাশ॥’
স্বামী, সন্তান, সংসারের মঙ্গলের জন্য গ্রামীণ নারীরা নানা ব্রত পালন করে থাকে। তাদের বিশ্বাস ব্রত পালন করলে মঙ্গল হয়। ব্রতের প্রধান কথা হল সৃষ্টিকর্তাকে তুষ্টির মাধ্যমে নিজের স্বার্থ হাসিল করা। মলুয়া পালায় স্বীয় সতীত্ব রক্ষার জন্য ব্রত পালনের কথা আমরা জানতে পারি।
‘বার মাসের বর্ত্ত মোর নয় মাসে গেছে ।
পরর্ত্তিষ্টা করিতে আর তিন মাস আছে॥’
লোকজীবনে লোকসমাজের নিষ্ঠুরতার চিত্রও আমরা দেখতে পাই। দেওয়ানের ঘরে মলুয়া বন্দী থাকার কারনে লোকসমাজ তার উপর নিষ্ঠুর আইন প্রণয়ন করে। মুসলমানের হাতে অন্ন খেয়েছে বলে মলুয়ার জাত নষ্ট হয়েছে, সে সমাজের অস্পৃশ্য ব্যক্তি। এর ফলে একটা সতী-সাদ্ধি নারীর জীবন অকালে নষ্ট হতে দেখা যায়। এখানে জাতের কাছে মানুষ গৌণ।
‘বিনোদের মামা বলে হালুয়ার সরদার।
যে ঘরে তুলিয়া লইবে জাতি যাইবে তার৷
বিনোদের পিশা কয় ভাবিয়া চিন্তিয়া।
ঘরেতে না লইব কন্যা জাতিধর্ম ছাড়িয়া॥’
ময়মনসিংহ গীতিকায় কাজলরেখা পালাটি মূলত রূপকথা। রূপকথায় অতিপ্রাকৃত শক্তির ভিড় বেশী এবং স্বর্গ- মর্ত্য-পাতাল ভেদী। যার কারনে এই পালা লোকজীবন ঘেঁষা নয়; তবে লোকউপাদান একেবারে উপেক্ষিতও নয়। কাজল রেখা যদি রূপকথা হয় তাহলে পালাটিই একটি লোকউপাদান। লোকজীবনে রূপকথার ভূমিকা অপরিসীম। কেননা এখনও রূপকথা লোকজীবনকে কেন্দ্র করেই বেঁচে আছে। তাই লোকজীবনের নানা অধ্যায় রূপকথায় চিত্রিত হয়েছে। কাজলরেখা পালায় লোকজীবনের নান্দনিক দিকের পরিচয় পাওয়া যায়। সূঁচ রাজার নির্দেশে কাজলরেখা কর্তৃক আলপনা আঁকা লোকজীবনের নান্দনিক দিকের পরিচয় বহন করে।
‘উত্তম সাইলের চাউল জলেতে ভিজাইয়া।
ধুইয়া মুছিয়া কন্যা লইল বাটিয়া৷
পিটালি করিয়া কন্যা পর্থমে আকিল।
বাপ আর মায়ের চরণ মনে গাঁথা ছিল ৷
জোরা টাইল আঁকে কন্যা আর ধানছড়া।
মাঝে মাঝে আঁকে কন্যা গিরলক্ষ্মীর পারা॥’
মনসুর বয়াতি প্রণীত দেওয়ানা মদিনা পালায় আমরা লোকজীবনের নানা লোকউপাদান ব্যবহারের চিত্র পাই। যা অবলোকন করে লোকজীবনধারা সম্পর্কে কিঞ্চিত হলেও ধারনা পাওয়া যায়। পালাটি শুরু হয় নারীর আর্তনাদ নিয়ে। যেখানে প্রকাশ পেয়েছে সন্তানের মঙ্গলার্থে নারীর বিধিনিষেধ। বর্তমানে মানুষ ধর্মের বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে একক বিবাহ রীতিতে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। কিন্তু লোকজীবনে ধর্মের সমর্থনে চারটা বিয়ে করার প্রবণতা এখনও বর্তমান। আর স্ত্রী মরে গেলে তো কথাই নেই। বউ মরে উলু পড়ে, ঘরে ঘরে বিয়ে করে। দেওয়ানা মদিনা পালায় শুরুতেই সতীন প্রসঙ্গ এসেছে, যা লোকজীবন সংশ্লিষ্ট।
‘সোনার কলি আলাল দুলাল আর তারার দিকে চাইয়া।
আমার মাথা খাও পিয়া আর সে কর বিয়া৷
সতীন বালাই কিয়া কই তোমার কাছে।
এতিম ধনেরা মোর দুঃখু পাইব পাছে॥’
নানান রকম বাহারী লোকখেলার মধ্য দিয়ে লোকজীবন অতিবাহিত হয়। এসব লোকখেলা লোকজীবনের সাথে একসূত্রে গাঁথা। কেননা লোকজীবনের আনন্দ বিনোদনের প্রধান একটা মাধ্যম হল লোকখেলা। ময়মনসিংহ গীতিকায় আমরা লোকখেলা বিশেষ করে জলের খেলা নৌকা বাইচের সাক্ষাত পাই। আবার নৌকা বাইচকে কেন্দ্র করে আড়ং বা মেলার কথাও উলেখ পাওয়া যায়। শ্রমক্লান্ত লোকজীবন একটু প্রশান্তির জন্য মেতে উঠে মিলন মেলায়।
‘নয়া পানিতে আরে দৌড়ের নাও সাজাইয়া।
আরং জমিব কত দেশ ভাসাইয়া॥’
লোকগীতিকা বা পালাগুলো মূলত লোকজীবনেই সৃষ্টি এবং বংশ পরম্পরায় তা প্রবহমান। কিন্তু সেটা লিখিতভাবে নয়, লোক মুখে মুখে। তাই পালাগুলো খাঁটি ফোকলোর উপাদান। লোককবি লোকসমাজ থেকে নানা সূত্র নিয়ে পালাগুলো রূপায়ণ করেছেন। এছাড়া লোককবি লোকসমাজেরই অংশ এবং লোকজীবনে বসবাসকারী মানুষ। তাই কবি লোকজীবনকে উপেক্ষা করতে পারেননি। প্রবহমান লোকজীবনের নানা দৃশ্য সংযোজন করে ময়মনসিংহ গীতিকার পালাগুলো রচনা করেছেন। সে কারনেই পালাগুলোর ছত্রে ছত্রে লোকজীবন চিত্র প্রস্ফুটিত হয়েছে। উন্মোচিত হয়েছে লোকজীবনের স্বরূপ। সভ্যতার অগ্রগতির ধারায় লোকজীবন আজ বিলুপ্তির পথে। শিল্পায়ন ও নগরায়নের প্রভাবে মানুষের জীবনযাত্রায় আধুনিকতার ছাপ পরিপুষ্ট। এ পরিবর্তন লোকজীবনেরই বিবর্তিত রূপ।
তথ্যপুঞ্জি :
১। ড. আশরাফ সিদ্দিকী – ‘পূর্ববঙ্গঃ মৈমনসিংহ গীতিকা’ ( দ্বিতীয় খন্ড), একুশে বইমেলা- ০৫, ঝিনুক প্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০৷
২। ডক্টর মযহারুল ইসলাম – ফোকলোরঃ পরিচিতি ও পঠন-পাঠন, ফেব্রুয়ারী-৯৩, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
৩। রায় বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেন কর্তৃক সঙ্কলিত – মৈমনসিংহ গীতিকা (পূবর্ববঙ্গগীতিকা , প্রথমখন্ড ,দ্বিতীয় সংখ্যা ,তৃতীয় সংস্করণ), ১৯৫৮, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়৷
৪। মাহবুবুল আলম(সম্পাঃ) – ময়মনসিংহ গীতিকা, ফেব্রুয়ারী/ ৭০, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, বাংলা বাজার,ঢাকা-১১০০৷