ঢাকা, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৮:২০ পূর্বাহ্ন
উপেক্ষিত ও বিস্মৃতির অন্তরালে রয়ে যাওয়া বিরল কবি বন্দে আলী মিয়া
ভাস্কর সরকার

আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,

থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর৷

পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,

এক সাথে খেলি আর পাঠশালে যাই৷

আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান,

আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইয়াছে প্রাণ৷

মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দিঘি,

চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি৷

আম গাছ, জাম গাছ, বাঁশ ঝাড় যেন,

মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন৷

সকালে সোনার রবি পুব দিকে ওঠে,

পাখি ডাকে, বায়ু বয়, নানা ফুল ফোটে৷

উপরিউক্ত বিখ্যাত কবিতাটি কার লেখা নিশ্চই এতোক্ষণে ঠাহর করতে পেরেছেন ৷ তিনি বিশ্বসাহিত্যে অমর কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিত্রকর, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারি শিশুতোষ কবি বন্দে আলী মিয়া। তাঁর মূল্যবান রচনা পড়লে মনের আকাশজুড়ে এক অনন্য নিদর্শন আকাশ তৈরি হয়। গান, গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কাব্যনাটক, গীতিনকশা, রূপকথা, জীবনী, ছোটদের জন্য অফুরন্ত রচনা, স্মৃতিকথাসহ একাধিক বিষয়ে বই লিখেছেন কবি বন্দে আলী মিয়া। সাহিত্যসেবায় তাঁর অনন্য প্রয়াস সার্থক করেছে বাংলাকে। তাঁর রচিত কাব্য ও শিশুসাহিত্য সমগ্র বাংলাকে নতুন আলোকে আলোকিত করেছে। তবু তিনি অনাদরে বিস্মৃতির অন্তরালে রয়ে গেলেন। কেন তিনি আজ বড় প্রাসঙ্গিক হয়েও আড়ালে রয়ে যাচ্ছেন? তার উত্তর আজও অধরা। মনকে আনন্দে ভরিয়ে দেন যে লেখক, সেই লেখক যদি উপেক্ষিত হন, তাহলে দুঃখ লাগাটাই স্বাভাবিক!

অমর কবির জন্ম ১৯০৬ সালের ১৭ জানুয়ারি, পাবনা জেলার রাধানগর নামক স্থানে। পিতা উমেদ আলী মিয়া ও মাতা নেকজান নেছার ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করে একটি শিশু যার নাম রাখা হয় বন্দে আলী মিয়া। কবির শৈশব আর কৈশোরও কাটে এই রাধানগরেই। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে কবি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন রাধানগর মজুমদার একাডেমি থেকে। এরপর ভর্তি হন কলকাতা আর্ট একাডেমিতে। ১৯২৭ সালে সেখান থেকে চিত্রকলায় ১ম বিভাগ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।

অবশ্য বন্দে আলী মিয়া তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন পড়াশোনা শেষ করার আগেই, সাংবাদিক হিসেবে। ১৯২৫ সালে তিনি ইসলাম দর্শন পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। পরে, ১৯৩০ সালে যোগ দেন কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে, সহকারী শিক্ষক হিসেবে। এখানে দীর্ঘ ২০ বছর চাকরি করে ১৯৫০ সালে অবসর গ্রহণ করেন বন্দে আলী মিয়া। ষাটের দশকে প্রথমে ঢাকা বেতারে ও পরে রাজশাহী বেতারে চাকরি করেন। পাশাপাশি কবি বিভিন্ন গ্রামোফোন কোম্পানির জন্য পালাগান ও নাটিকাও রচনা করেন। সেগুলো রেকর্ড আকারে বের হলে বেশ জনপ্রিয়ও হয়।

এতকিছু করেও অবশ্য বন্দে আলী মিয়া খুব একটা স্বচ্ছলতার মুখ দেখেননি। সত্যি বলতে কি, তার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে দারিদ্র্যে। তাতে কী, কবি কিন্তু কখনও সাহিত্যচর্চায় আপোষ করেননি। লিখে গেছেন অবিরাম। লিখেছেন বাংলার জীবন ও প্রকৃতির রূপ নিয়ে। আর লিখেছেন ছোটদের নিয়ে, ছোটদের জন্য, ছোটদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য।

বন্দে আলী মিয়া সব মিলিয়ে প্রায় দেড়শ’র মতো বই লিখেছেন। যার মধ্যে ১০৫টি বই ছোটদের জন্য। তার উল্লেখযোগ্য বইগুলো হচ্ছে- ‘ময়নামতির চর’, ‘অরণ্য’, ‘গোধূলী’, ‘ঝড়ের সংকেত’, ‘নীড়ভ্রষ্ট’, ‘জীবনের দিনগুলো’, ‘অনুরাগ’। আর ছোটদের জন্য লেখা বইগুলোর মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল চোর জামাই, মেঘকুমারী,  মৃগপরী, বোকা জামাই, কামাল আতাতুর্ক, ডাইনি বউ, রূপকথা, কুঁচবরণ কন্যা, ছোটদের নজরুল, শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা, বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা ইত্যাদি।

ছোটবেলায় রূপকথার গল্প শোনেনি কিংবা পড়েনি এমন মানুষ পাওয়া নিশ্চয় কষ্টেরই হবে৷ প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে রূপকথার গল্প বলায়ও এসেছে পরিবর্তন৷ তবে একটা সময় ছিল যখন দাদি-নানিরা রূপকথার গল্প শোনাতেন৷ তখন খুব বেশি গল্প না থাকায় দেখা যেত যে, কয়েকটা গল্পই ঘুরে ফিরে শোনা যাচ্ছে৷ ফলে সেগুলো মনে গেঁথে যেত৷ ফোকলোর চর্চায় এমন রূপকথা, পরীকথা, পশুকথা ইত্যাদি গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রত্যয়৷ এসব রূপকথায় অনেক পুরনো থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের দৈনন্দিন সমস্যাগুলোর কথা কাব্যিক ও প্রতীকি উপায়ে প্রকাশ করা হয়৷ এছাড়া ছোটদের এমন গল্পকথার মধ্যে সামাজিক ন্যায় বিচার, ভালো-মন্দের দিক নির্দেশনাও থাকে৷ কবি বন্দে আলী মিয়া ছোটদের জন্য এমন নানা গল্পকথা রচনা করে গেছেন৷

বন্দে আলী মিয়া সাহিত্যকীর্তির জন্য তৎকালে অনেক পুরস্কার-সম্মাননা পেয়েছেন। শিশুসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ১৯৬২ সালে পান বাংলা একাডেমী পুরস্কার। ১৯৬৫ সালে পান প্রেসিডেন্ট পদক। মৃত্যুর পরও তিনি পেয়েছেন দুটো মরণোত্তর পদক ১৯৮৮ সালে একুশে পদক, ১৯৯০ সালে স্বাধীনতা পদক।

কিন্তু এই খ্যাতিমান কবি এই সময়ে এসে পাঠ্যপুস্তক সহো বাংলা সাহিত্যের চলমান আসরে ব্রাত্য থেকে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। শিশু ও বড়দের অনুপ্রেরণা দিতে এবং নতুন সাহিত্য সাধনায় এগিয়ে আসতে সাহস জোগান এসব বিদগ্ধ কবি–সাহিত্যিক।

উপেক্ষিত ও বিস্মৃতির অন্তরালে রয়ে যাওয়া বিরল কবি ও কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম হলেন কবি বন্দে আলী মিয়া। সাহিত্যচর্চা নিয়ে আমাদের ভাবার সময় এসেছে। তাঁর রচিত বইগুলো নতুন করে প্রকাশিত হোক। বাংলা একাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটি, ইউপিএল সহো অন্যান্য প্রকাশণা সংস্থা তাঁর রচনাসমগ্র নতুন করে প্রকাশের উদ্যোগ নিবে আশাকরি। কবির পাঠকেরা এখন চাইছেন এক মলাটে কবিকে পেতে। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টি আমাদের মুগ্ধ করে। এই কবির লেখা গ্রন্থ পড়লে মনের প্রসারতা বাড়ে, অনন্ত ভালো লাগায় মেতে ওঠা যায়। বাংলাদেশের এই অসামান্য প্রতিভাবান কবি বন্দে আলী মিয়া, ছোটদের গল্পদাদু ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন রাজশাহীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে অপার্থিব জগতে চলে যান। আজ তাঁর ৪২ তম প্রয়াণ দিবস৷

One response to “উপেক্ষিত ও বিস্মৃতির অন্তরালে রয়ে যাওয়া বিরল কবি বন্দে আলী মিয়া”

  1. … [Trackback]

    […] Find More to that Topic: doinikdak.com/news/29658 […]

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x