দেখতে দেখতে বছর অতিবাহিত করলো ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। গতবছর এ সময়ে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত আনে এই ঘূর্ণিঝড় । যার প্রভাব আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি উপকূলবর্তী মানুষগুলো। আজও আঁতকে ওঠে তারা সেই ভয়াল রাতের কথা মনে করে। ঘরে খাবার নেই, মাথার উপরে খোলা আকাশ, পায়ের নিচে হাঁটু সমান লোনা জল সবই যেন এখন তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মানুষগুলো গৃহপালিত পশু নিয়েও একই ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস করতে দেখা গেছে। বছরে জৈষ্ঠ্যের পরেই আসে আষাঢ়। আর এই আষাঢ়ই যেন উপকূলীয় অঞ্চলে এক আতংক সৃষ্টিকারী শব্দ। তীব্র খাবার পানির সংকট, দু’বেলা খাবারের আহাজারি, ছেলে মেয়ে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস সকল সমস্যাই যেন সৃষ্টি হয়েছে উপকূলবর্তী মানুষের জন্য। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান পরবর্তী সময়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি উপকূলীয় উপজেলার মানুষের সাথে। দেখেছি তাদের বুকফাটা কান্না। বুঝেছি তাদের অব্যক্ত কথাগুলো। উপকূলবাসী ঝড়কে ভয় পাই না, ভয় পাই লাজুক বেড়িবাঁধকে। ঝড়ের থেকে বেশি ক্ষতি হবে যদি বাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হয়ে যায়। এ কথাগুলে ওই জনপদের একজন বা দু-জন মানুষের নয়। প্রতিটি মানুষই চেয়েছে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ। উপকূলীয় ভুক্তভোগী এই পরিবারগুলো যখন রাস্তায় নামে এই বেড়িবাঁধের জন্য তখন তাদের কষ্টের কথাগুলো আসলেই হৃদয় ছুঁয়ে যায়।কিন্তু আমার হৃদয় ছুঁয়ে লাভ কি বলেন ! হৃদয় ছোঁয়াতে হবে সংশ্লিষ্টদের। তাতেই হবে মঙ্গল। কিন্তু এ হৃদয় সবার মন ছুঁয়ে গেলেও তাদের যায় না। কেন যায় না সে উত্তর কেবল তাদের কাছেই রয়েছে। তারা সময় আসলে প্রতিশ্রুতি দেয়। বাঁধ হবে, খাদ্য সহায়তা হবে, আশ্রয়ের ব্যবস্থা হবে কিন্তু বাস্তবায়নের এই প্রতিশ্রুতির সাথে কোন মিল খুজে পায়না তারা। কেন এই জনপদের মানুষগুলোর কাছে মিথ্যা আশ্বাস দেয়, স্বপ্ন দেখায় সেটা আসলে কারো কাছে বোধগম্য নয়। তাদের এই মিথ্যা আশ্বাস, মধুর বাণী এই অসহায় অবহেলিত মানুষগুলো এখন আর আমলে নেয় না। তারা সেদিনই বিশ্বাস করবে যেদিন এ কথাগুলোর বাস্তবায়ন ঘটবে। আমাদের দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের শেষ উপজেলা খুলনার কয়রা। উপজেলাটির চারদিকে নদী বেষ্টিত। শুধুমাত্র পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ দু’টি জনপদকে ঘিরে রেখেছে। দুর্বল বেড়িবাঁধের কারণে বর্ষা মৌসুমে আবহাওয়া বিরূপ হলে পানির চাপে কোথাও জনপদের বেশ কিছু জায়গা রূপ নেয় স্থায়ী জলাবদ্ধতায়। মাঝে মধ্যে গ্রীষ্ম মৌসুমেও বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি ঢোকে। পাশ্ববর্তী সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তান্ডবের এক বছরেও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি লক্ষাধিক মানুষ। ঘূর্ণিঝড় ও জোয়ারের প্রবল চাপে বাঁধ ভেঙে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের সংলগ্ন এলাকা। এসব জায়গার কমবেশি কয়েকটি বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে লোকালয়ে। প্লাবিত হয় চিংড়ি ঘের।
সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় ইয়াশ। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে ২৫ মে মধ্যরাত থেকে ২৬ মে সন্ধ্যার মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াশ’ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। আম্পান যেদিক দিয়ে স্থলভাগে প্রবেশ করেছিল, সেই সাতক্ষীরা ও খুলনার ওপর দিয়ে সম্ভাব্য আঘাতটা হানতে পারে এ ঘূর্ণিঝড়।
ঘূণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার অতিমাত্রায় জোয়ারের পানিতে উপজেলার শাকবাড়ীয়া ও কপোতাক্ষ নদীর প্রায় ৩০ কিলোমিটার বেঁড়িবাঁধ ছাপিয়ে লোকালয়ে লবণ পানি প্রবেশ করে। এ ছাড়া উত্তর বেদকাশির গাতীরঘেরি ও মহারাজপুর ইউনিয়নের মঠবাড়ী গ্রামের বেঁড়িবাঁধ ভেঙ্গে ৪ টি গ্রাম প্লাবিত হয়। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দমকা হাওয়া বয়ে যাওয়ায় বুধবারের চেয়ে ২ থেকে ৩ ফুট জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় দুপুরের পর থেকেই বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে বেঁড়িবাঁধ ভেঙ্গে যায়।
সূত্র জানায় বৃহস্পতিবার বেলা ২ টার মধ্যে দক্ষিণ বেদকাশির আংটিহারা, মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া গ্রামের অর্ধ কিলোমিটার বেঁড়িবাঁধ নতুন করে ভেঙ্গে যাওয়ায় কয়রা খুলনা সড়কের কালনা ও অন্তাবুনিয়া গ্রামে ৩ কিলোমিটিার সড়ক সম্পূর্ণ পানির তলে।
কয়রা উপজেলার ৩ টি ইউনিয়নে ৫ টি স্থানে বেঁড়ি ভেঙ্গে গেলেও প্লাবিত হয়েছে ৪ টি ইউনিয়ন। এর মধ্যে মহারাজপুর ও দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের ৩৫ টি গ্রাম সহ উত্তর বেদকাশি ও কয়রা ইউনিয়নের ১২ টি গ্রাম এখন লবন পানিতে ভাসছে । তবে উপজেলা সদর থেকে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়ায় খবর নিয়ে জানা গেছে উত্তর বেদকাশি গাতিরঘেরী, বিনাপানি, পদ্দপুকুর ও হরিহরপুর গ্রামে ৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে তিল পরিমাণ জায়গা না থাকায় অধিকাংশ মানুষের ঠাই হয়েছে বেঁড়িবাঁধের খোলা আকাশের নিচে।
অনুরুপ উত্তর ও দক্ষিণ মঠবাড়ী গ্রামে ভাসমান মানুষআশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় না পেয়ে বেঁড়িবাঁধে উঠেছে। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় সহ¯্রাধিক চিংড়ী ঘের, শতশত বাড়ী ঘর ভেসে গেছে এবং গরু, ছাগল, হাস মুরগি পানির মধ্যে দিকবিদিক ভেসে যেতে দেখা যায়। তবে উপজেলা প্রশাসন এখনও ক্ষয়ক্ষতির নিরুপন করতে পারে নি বলে জানিয়েছে।
নদী ও সুমুদ্র তীরবর্তী বেড়িবাঁধ দেখভালের দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যানুযায়ী, দেশে প্রায় ১৭ হাজার কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। এরমধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে রয়েছে পাঁচ হাজার ৭৫৭ কিলোমিটার বাঁধ। যার পুরোটাই এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। ষাটের দশকে ফসলী জমি বাড়াতে নির্মিত ওই বাঁধ সংস্কারে বিভিন্ন সময়ে প্রকল্প নেওয়া হলেও তা কাজে আসেনি। বরং সিডর, আইলা ও আম্ফানের মতো ঘূর্ণিঝড়ে বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
ষাটের দশকে নির্মিত উপকূলীয় বেড়িবাঁধ যথাযথ সংস্কারের অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। এরপর সুপার সাইক্লোন আম্ফানের এবং সর্বশেস ইয়াশ এর কারনে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেড়িবাঁধ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে কারণে চরম ঝুঁকিতে আছে উপকূলীয় ২৫ জেলার প্রায় ৫ কোটি মানুষ। সেই ঝুঁকি মোকাবেলায় নতুন মেগা প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বাঁধকে টেকসই করতে নকশা পরিবর্তন করা হচ্ছে। আর বাঁধ নির্মাণের পর তা রক্ষণাবেক্ষণে নতুন পরিকল্পনা নেওয়া হবে।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চলের বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজ দ্রুততার সঙ্গে চলছে বলে জানিয়েছেন পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম। তিনি বলেছেন, স্থানীয় জনগণের সহায়তায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বাঁধ সংস্কারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় সকল সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ওই অঞ্চলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য গৃহীত মেগা প্রকল্পসমূহ দ্রুত একনেকে পাস করার বিষয়ে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন।
উপকূলীয় অঞ্চলের বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজ প্রধানমন্ত্রী নিজেই মনিটারিং করছেন বলে জানান উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম। তিনি বলেন, ঝড়ের দিন রাতেই প্রধানমন্ত্রী খোঁজ-খবর নিয়েছেন। তিনি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত অনুমোদনের জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। যার মধ্যে খুলনা জেলার কয়রার ১৪/১ নং পোল্ডারে উত্তর ও দক্ষিণ বেদকাশির বাঁধ নির্মাণে এক হাজার ১৭৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা এবং সাতক্ষীরা জেলার গাবুরায় ১৫নং পোল্ডারে বাঁধ নির্মাণে এক হাজার ২৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকার দু’টি প্রকল্প চলতি সপ্তাহেই একনেকের বৈঠকে তিনটি মেগা প্রকল্প পাস হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
উপমন্ত্রী আরো বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্যের চাহিদার প্রেক্ষিতে ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ সংস্কারের জন্য বস্তা, বাঁশ, টিনসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা মাঠে থেকে কাজের তদারকি করছেন। পানি সচিব নিজেই ওই এলাকায় আছেন। ২/৪ দিনের মধ্যে সংস্কার কাজ শেষ করে জোয়ারের পানি আটকানো সম্ভব হবে। এছাড়া বেড়িবাঁধ সংস্কারের চলমান প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, অতীতে বেড়িবাঁধ সংস্কার, নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষন সবকিছুতেই স্থানীয় জনগণের মতামত উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে প্রতিবছর সরকারি কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও টেকসই বেড়িবাঁধ হয়নি। অথচ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে বেড়িবাঁধের ওপর। বাঁধের তি হলে সবকিছু ভেসে যায়। বাড়িঘর নষ্ট ও ফসলের তি হয়। তাই ওই অঞ্চলের মানুষের প্রধান দাবি, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ। এক্ষেত্রে বেশ কিছু সুপারিশও তুলে ধরা হয়েছে।
এজন্য এ জনপদের মানুষদের বাঁচাতে জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগকে মাথায় রেখে স্থায়ী, মজবুত ও টেকসই বেড়িবাঁধ পুনঃনির্মাণ করতে হবে। বাঁধের নদীর সাইডে পর্যাপ্ত জায়গা রাখে এবং সেখানে বৃক্ষরোপণ করতে হবে, যেসব স্থানে বারবার বাঁধ ভাঙছে সেইসব স্থান চিহ্নিত করে সেখানে ব্লকের মাধ্যমে কংক্রিটের বাঁধ নির্মাণ করতে হবে, বাঁধ নির্মাণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নিজস্ব জমি না থাকলে ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে, বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জরুরী তহবিল গঠন ও বাঁধ ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করা ও বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে সবধরনের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। তাহলেই কেবল রচিত হবে উপকূলীয় জনপদের মানুষের লড়াই করে বেঁচে থাকার গল্পের ইতিহাস।