ঢাকা, সোমবার ১০ মার্চ ২০২৫, ১০:৩৪ পূর্বাহ্ন
বায়েজিদ বোস্তামি (র.) : একজন মরমি সুফি সাধক
ভাস্কর সরকার

তিনশত ষাট আউলিয়ার দেশ বললে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব কোণের সিলেট বিভাগকে বুঝে নেয়া হয়। আর বারো আউলিয়ার দেশ বললে চট্টগ্রাম অঞ্চল বোঝায়। এই বারো আউলিয়াদের অন্যতম হচ্ছেন সুলতানুল আরেফিন হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.)৷ তিনি ইরান দেশের বর্তমান রাজধানী তেহরানের পার্শ্ববর্তী কুমিস নামক প্রদেশের অন্তর্গত খোরাসানের প্রসিদ্ধ শহর বোস্তাম নামের এক এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। হিজরি ১২৮ সনে এবং ৭৪৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণকারী এই মহান ব্যক্তির জন্মস্থান বোস্তাম হওয়াতে তাঁর নামের সাথে বোস্তামি শব্দটি সংযোজিত হয়েছে। অতীতকালে বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামের সাথে জন্মস্থানের নাম সহজ পরিচয়ের সুবিধার্থে জুড়ে দেয়া হতো। এখনও আমাদের বর্তমান সময়ের ধর্মীয় অনেক বক্তার নামের সাথে তাঁদের নিজ নিজ এলাকার নামের ব্যবহার চোখে পড়ে। বায়েজিদ বোস্তামির মূল নাম তায়ফুর। আর ইয়াজিদ তাঁর উপনাম। নামটি কালক্রমে বায়েজিদ হয়ে যায়। তাঁর পিতার নাম ঈসা এবং তিনি তাবেয়িনদের সাক্ষাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন বলে তাকে তাবে তাবেইন বলা হয়ে থাকে। তবে তাঁর পিতামহ প্রথম জীবনে মুসলমান ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন অগ্নি ও মূর্তিপুজারী৷ পরবর্তীতে কোনো এক ইসলাম ধর্ম প্রচারকের সান্নিধ্য পেয়ে ইসলাম ধর্ম কবুল করেন। বায়েজিদ বোস্তামির মাতা ছিলেন একজন ধৈর্য্যশীলা এবং চরিত্রে উন্নত মহিলা একথা সর্বজন স্বীকৃত। সৎ পিতা মাতার প্রভাবে প্রভাবিত যোগ্য সন্তান হচ্ছেন বায়েজিদ যিনি পরবর্তী জীবনে সুফি সাধক হয়েছিলেন।

হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) যেমনি ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী, তেমনি পড়ালেখায় বিশেষ মনোযোগী। ফলে শিক্ষা জীবনের প্রথম পর্যায়েই শিক্ষকদের শুভ দৃষ্টি তাঁর ওপর পড়ে। তাঁর চলাফেরা, কথাবার্তা, আদব-ভক্তি এবং নিয়মিত যাতায়াত ও পড়াশোনা শিক্ষকগণকে মুগ্ধ করে। কুরআন-হাদিস, ফিকাহ শাস্ত্র, তাসাউফ এবং শরীয়তের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান লাভের মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে মায়ের অনুমতি এবং দোয়া নিয়ে তিনি বিভিন্ন দেশের দিকে যাত্রা করেন। দীর্ঘ তিন বছরে প্রায় একশত সত্তর জন তৎকালীন বিখ্যাত মুহাদ্দেস, ফক্বীহ এবং বিজ্ঞ আলেমগণের সান্নিধ্যে গিয়ে পবিত্র কুরআন-হাদিসসহ শরীয়তের বিভিন্ন শাখা উপশাখায় গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। এ তিন বছর জ্ঞানার্জনে এমন সাধনা করেছিলেন যে তিনি পানাহার, আরাম-আয়েশ এবং নিদ্রা পরিত্যাগ করে বিরামহীনভাবে এক দেশ হতে অন্য দেশে, এক জ্ঞানীর জ্ঞান আহরণ করে অন্য জ্ঞানীর সন্ধানে ছুটে বেড়িয়েছিলেন।

হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (রাহঃ) এর মাতৃভক্তির ঘটনা দুনিয়া জোড়া খ্যাতি অর্জন করেছে৷ মায়ের প্রতি নজির বিহীন ভক্তি-শ্রদ্ধার দৃষ্টান্ত স্বরূপ এই গল্পটি এক সময় বাংলাদেশের স্কুল, মাদরাসার পাঠ্য বইয়ে লিপিবদ্ধ ছিল৷ একদা বায়েজিদ বোস্তামির মা অসুস্থ ছিলেন। এক রাতে মা বায়েজিদ বোস্তামিকে পানি পান করবার জন্য পানি আনতে বলেন। তখন বায়েজিদ বালক ছিলেন, ঘরে পানি না পেয়ে অন্ধকার রাতে প্রথমে পার্শ্বের ঘর গুলোতে পানি তালাশ করেন৷ কিন্তু কোথাও পানি না পেয়ে পানির অনুসন্ধানে বহুদূরে নদী থেকে তিনি পানি নিয়ে আসেন। এসে দেখলেন মা ঘুমিয়ে আছেন। মা আবার ঘুম থেকে উঠে পানি পান করতে চাইবেন বা মাকে ঘুম থেকে ডেকে উঠালে মায়ের কষ্ট হবে, তাই ভেবে তিনি পানি হাতে সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকলেন। তখন শীতের রাত ছিল৷ ফজরের সময় মায়ের ঘুম ভাঙার পর দেখলেন তার ছেলে পানি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিষয়টা কি তা জিজ্ঞাসা করে সব জানতে পারলেন তাঁর মা। সাথে সাথে বায়েজিদের মা ফজরের নামাজে সিজদায় পড়ে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেন, “আল্লাহ তুমি আমার বায়েজীদকে সুলতানুল আরেফিন বানিয়ে দাও” (আল্লাহ ওয়ালাদের বাদশা বানিয়ে দাও)৷

মহান আল্লাহ তাঁর মায়ের দোয়া কবুল করেন৷

মূলত মায়ের দোয়ার কারণেই আল্লাহ তায়ালার অশেষ দয়ায় পরবর্তী জীবনে বায়েজিদ বোস্তামি বিশ্বে স্মরণীয় এবং বরণীয় এক মহান আউলিয়া হয়েছিলেন। এটাকেই বলে মা ভক্তি৷ বালক বায়েজিদ কোনোদিন সত্যি সত্যি এমন করেছিলেন কিনা সেটা আমাদের জানবার কোনোরকম উপায় নেই, কারণ এ কাহিনীটা আমরা কোনো জীবনীগ্রন্থে পাই না, পাই কেবল লোককাহিনী আর কবিতাগ্রন্থে। যেমন কালিদাসের কবিতায় আমরা এ কাহিনী পাই, যেখানে মা আবেগে বলে উঠেনঃ

“কহিল মা, মরি মরি!

বাছারে আমার পানি হাতে করে সারা রাত্রটি ধরি

দাঁড়াইয়া আছো? ঘুমাওনি আজ? চোখে এলো জল ভরি।”

মহান রাব্বুল আলামিন মানবজাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য দুটি অলৌকিক শক্তি সৃষ্টি করেছেন। প্রথমত: নবুয়্যত, এ নবুয়্যতপ্রাপ্তরা হলেন নবী-রাসুলগণ। দ্বিতীয়ত: বেলায়ত, এ বেলায়তের অধিকারি হলেন আউলিয়ায়ে কেরাম। যারা নবীগণের সাহায্যকারী ও প্রতিনিধি। সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে এ দুই শ্রেণীর মাধ্যমে হেদায়তের কার্যক্রম চলে আসছে। সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (দ.) এর ইন্তেকালের পর এ দায়িত্ব এককভাবে পালন করে আসছেন হক্কানী-রব্বানী আলেম, আউলিয়ায়ে কেরাম। যে সব মহামনীষির পদধুলির বদৌলতে এ অঞ্চলে সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচার-প্রসার হয়েছে, তাঁদের মধ্যে সুলতানুল আরেফিন হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) অন্যতম।

ইতিহাস ভিত্তিক সুদৃঢ় প্রমাণ না পাওয়া গেলেও কথিত আছে- দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বাংলাদেশের চট্টগ্রামে আসেন সুফি সাধক, জ্ঞানী, আল-কোরআনের শিক্ষায় আলোকিত হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.)। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষদের কাছে চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ এর এক পাহাড়ের উপর অবস্থিত স্থাপনাটি বায়েজিদ বোস্তামির মাজার নামেই এক কথায় পরিচিত৷ তবে এ কথা সত্য যে, খ্রীস্টিয় অষ্টম শতাব্দীতে আমাদের এ অঞ্চলে আরব ব্যবসায়ীদের আসা যাওয়া ছিল। সে বিবেচনায় পরবর্তী কোনো এক সময়ে চট্টগ্রাম উপকূলে বায়েজিদ বোস্তামির আগমন ঘটে থাকতে পারে। জনশ্রুতি আছে, বায়েজিদ বোস্তামি চট্টগ্রাম এসেছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনি এখানে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেনি। তবে যে সকল ধর্মপ্রাণ মনীষী দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের আমাদের এই বাংলাভূমিতে এসেছেন, যুগে যুগে শান্তির বার্তা নিয়ে ইসলাম ধর্মের প্রচারের জন্য এবং যাদের কঠোর সাধনায় দিনে দিনে তা প্রসার লাভ করেছে, তাদেরই একজন হচ্ছেন আদর্শ পুরুষ সুলতানুল আরেফিন হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.)৷ চট্টগ্রামে নির্মিত দরগাহ পাহাড়ের পাদদেশে একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মোঘলরীতির আয়তাকার মসজিদ এবং একটি বিশালাকার দীঘি আছে। স্থাপত্যশৈলী থেকে ধারনা করা হয় মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে মসজিদটি নির্মিত হয়। আর এ বিশাল দীঘিতে রয়েছে কাছিম ও গজার মাছ । আঞ্চলিকভাবে এদের মাজারী ও গজারী বলে আখ্যায়িত করা হয়। বোস্তামির কাছিম আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি অত্যন্ত বিরল এবং চরমভাবে বিপন্নপ্রায় প্রজাতি। এই প্রজাতির কচ্ছপ বর্তমানে শুধু চট্টগ্রামের হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) দরগাহ সংলগ্ন পুকুরেই টিকে আছে। পৃথিবীর কোথাও এই প্রজাতির কচ্ছপ আর দেখা যায় না। ২০০২ সালে পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সংস্থা “আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ” কর্তৃক বোস্তামির মাজারের কচ্ছপকে চরমভাবে বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতি হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়৷ কচ্ছোপগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- আকারে অনেক বড় হয় এবং ওজনও বেশি হয়। এছাড়া কালের সাক্ষ্য হয়ে শত শত বছর এদের বেঁচে থাকার অপূর্ব ক্ষমতা আছে।

তাঁর কিছু নসীহত বা বাণী ও মোনাজাত:

১. হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) কে প্রশ্ন করা হলো আরশ কি ?

তিনি উত্তর দিলেন, “আরশ আমি নিজেই”৷

২. তিনি বলেন, আল্লাহর যিকির করতে করতে এক রাতে আমি নিজের মনকে তালাশ করতে লাগলাম কিন্তু পেলাম না। ভোররাতে শুনতে পেলাম, “হে বায়েজিদ, আমাকে ছাড়া অন্য বস্তুর তালাশ করছ কেন? আমাকে তালাশ করলে আবার অন্তরকে কেন তালাশ করছ”?

৩. আমি দুনিয়াকে তিন তালাক দিয়ে সম্পূর্ণ এক হলাম এবং আল্লাহ পাকের দরবারে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলাম, “হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া আমার আর কেহ নেই। তুমি যখন আমার রয়েছ তখন সবই আমার আছে”।

৪. আমি রবকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার দিকের পথ কোনটি? উত্তরে বলেন, “আমিত্ব ভাব ছেড়ে দাও, তাহলেই আমার দিদার লাভ করতে পারবে”৷

৫. লোকে মৃত ব্যক্তি হতে জ্ঞান লাভ করে আর আমি এমন চিরজীবীত হতে জ্ঞান লাভ করেছি, যাঁর কখনও মৃত্যু নাই।

৬. সকল লোকে আল্লাহর কালাম বলে, আর আমি আল্লাহর পক্ষ হতে বলে থাকি।

৭. আমি রিপুকে আল্লাহর প্রতি রুজু করি। সে রিপু যখন তা অস্বীকার করে, তখন আমি একাই ইলাহীর কাছে হাজির হলাম।

৮. একদিন তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, “মানুষ কখন বুঝতে পারে যে, মারিফাতের গোপন তত্ত্বে পৌঁছতে পেরেছে?

উত্তরে বলেন, “যখন আল্লাহর প্রেমে নিজেকে বিলীন করে দেয়”।

৯.  মুনাজাত:

হে আল্লাহ! আর কতকাল আমার এবং তোমার মধ্যে “আমি” ও “তুমি” এ ব্যবধান থাকবে? আমার “আমি” আমা হতে দূর কর, তা হলে সে “আমি” কেবল তোমাতেই থাকব, আর কিছুই থাকবে না।

হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) ৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে ১৩১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন এবং বোস্তাম শহরে তাঁকে দাফন করা হয়। বিশ্বের সকল অঞ্চল থেকে আজও মুসলিম দর্শনার্থীরা তার মাজার জিয়ারত করার জন্য বোস্তাম শহরে যান। বায়েজিদ বোস্তামি (স.) ইসলামের শান্তির বাণী প্রচারের জন্য সফর কালীন সময়ে যেখানেই তিনি অবস্থান করে ইবাদত-রিয়াযত ও সাধনা করেছেন, সেখানেই গঠিত হয়েছে খানকাহ তথা দরগাহ শরীফ। গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রায় চল্লিশটির মত তাঁর দরগাহ শরীফ বিদ্যমান। শুধু মিশরের মধ্যেই তিনটি। চট্টগ্রামের নাসিরাবাদস্থ কুমাদান পাহাড়ের চূড়ায় যে স্থানটি ইবাদত-রিয়াযতের জন্য নির্বাচিত করে খানকাহ তৈরি করেছিলেন এবং যেখানে সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করেন, সেই স্থানটিই বর্তমান “হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) দরগাহ শরীফ” নামে পরিচিত। নবী-রসূল ও অলি আল্লাহদের ইবাদতস্থল তথা খানকাহ এবং তাঁদের ব্যবহৃত কিংবা সম্পর্কিত বস্তু যে অন্যদের জন্য ইবাদতগাহ, আল্লাহর রহমত অবতির্ণের কেন্দ্রস্থল এবং দোয়া কবুলের বড় মাধ্যম সে ব্যাপারে পবিত্র কুরআন- হাদিসের অসংখ্য দলিল ও হক্কানী ওলামায়ে কেরামের গবেষণামূলক বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত এবং শরীয়ত সম্মত৷ পবিত্র আল-কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- “যারা এ কাজে (আসহাবে কাহাফের মাযার সংরক্ষণের ব্যাপারে) প্রবল ছিল, তারা (সুন্নী) বলল : আমরা অবশ্যই আসহাবে কাহাফের (মাযারের) উপর একটি মসজিদ নির্মাণ করবো।” (কাহাফ:২১) তাই হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) দরগাহ শরীফে দীর্ঘ প্রায় বারশত বছর ধরে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষ জিয়ারত করে ইহকালীন ও পরকালীন সফলতা অর্জন করে আসছেন৷

x