ঢাকা, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৫:৩৮ অপরাহ্ন
ফাইল গুনে গুনে ঘুস
তোহুর আহমদ

অফিসে আবেদন জমা পড়লেই টাকার গন্ধ খোঁজেন একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ পাসপোর্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারা ঘুসের টাকা নেন ফাইল গুনে গুনে। দালালচক্রের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়ে এরা গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী এক সিন্ডিকেট। যাদের হাতে অবৈধ আয়ের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।

কেউ কেউ রাতারাতি অর্থসম্পদে আঙুল ফুলে হয়েছেন কলাগাছ। তাদের আছে চেয়ারে টিকে থাকার শক্ত প্রটেকশন। যে কারণে দু-একজন সৎ কর্মকর্তা থাকলেও তারা পাসপোর্টকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারছেন না। ফলে দুর্নীতিবাজ চক্রের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হতে পারছে না পাসপোর্ট সেবা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক র‌্যাবের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা পাসপোর্ট অফিসে আর কোনো অভিযান পরিচালনা করব না। এভাবে দালাল ধরে কোনো লাভ হবে না। আগে পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের ঘুস নেওয়া বন্ধ করতে হবে। ভেতরে ঘুস নেওয়া অব্যাহত থাকলে বাইরে থেকে দালাল ধরে কী হবে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার শুরু করবে।’ তিনি বলেন, ‘ভেতরে মধু খাওয়ার সুযোগ থাকলে তো বাইরে থেকে মধু পাঠানো বন্ধ হবে না।’

পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সেলিনা বানু মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘অফিসের ভেতরের দুর্নীতি বন্ধে আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। তবে শতভাগ দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে, সে দাবি করছি না।’ তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি বন্ধে গণশুনানি থেকে শুরু করে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্তের ব্যবস্থা, বিভাগীয় মামলাসহ আইনানুগ সবকিছু করা হচ্ছে।’

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় প্রতিদিনই একটি নির্দিস্ট সময়ে দালালের মাধ্যমে ঘুসের ফাইল জমা নেওয়া হয়। সাধারণত বেলা ৩টার পর আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের ৫০১ নম্বর কক্ষে অবৈধ এ কার্যক্রম চলে। দালালের কাছ থেকে আদায় করা ঘুসের টাকা ভাগবাঁটোয়ারা হয় সন্ধ্যার পর। এজন্য অফিস সময়ের পরও কর্মকর্তাদের অনেকে অফিসেই বসে থাকেন। লেনদেন বুঝে নিয়ে কেউ কেউ বাসার উদ্দেশে গাড়িতে ওঠেন রাত ৮টার পর।

সূত্র বলছে, আগারগাঁও বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে বেশির ভাগ আবেদন জমা হয় ‘ঘুস চ্যানেলে’। আবেদনপ্রতি ন্যূনতম ঘুস নেওয়া হয় ২ হাজার টাকা। এ হিসাবে দৈনিক ঘুসের পরিমাণ দাঁড়ায় নিদেনপক্ষে ১০ লাখ টাকা। মাসে আসে প্রায় ৩ কোটি টাকা।

সূত্র বলছে, শুধু ঢাকার পাসপোর্ট অফিস নয়, দেশের ৬৪টি জেলার পাসপোর্ট অফিসেই আছে দালালচক্রের নির্বিঘ্ন দৌরাত্ম্য। ঘুস না দিলে পদে পদে হয়রানি আর চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। নানাবিধ উদ্যোগ সত্ত্বেও পাসপোর্ট সেবা অনেকটাই যেন আটকে গেছে দুর্নীতির দুষ্টচক্রে। বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালী, চাঁদপুর, যশোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও চাঁন্দগাঁও পাসপোর্ট অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্য এখন চরমে। সংশ্লিষ্ট অফিসের কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুস দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে।

যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে অন্তত ৩০ জন পাসপোর্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। যাদের অনেকের বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান চলমান। দুর্নীতিসংশ্লিষ্টরা হলেন উপপরিচালক তারিক সালমান, সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান, সহকারী পরিচালক রাশেদুল ইসলাম, ভিসা শাখার কর্মকর্তা বাশার, উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) আজিজুর রহমান, নারায়ণগঞ্জের ডিএডি মিজানুর রহমান, গাড়িচালক রুবেল এবং আনসার সদস্য তরিকুল ইসলাম। উল্লিখিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আয়বহির্ভূত সম্পদের তথ্য-উপাত্ত যুগান্তরের কাছে সংরক্ষিত আছে।

এছাড়া ঘুস দুর্নীতির অভিযোগে অধিদপ্তরের মেনটেইন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ সাচ্চু মিয়া, সহকারী পরিচালক নাসরিন নূপুর এবং সহকারী মেনটেইন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার কানিজ ফাতিমাকে গত সপ্তাহে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। আরও অন্তত ২০ জন পাসপোর্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলছে।

সূত্র বলছে, পাসপোর্ট অফিসের ঘাটে ঘাটে ঘুসের রেট বাঁধা। নতুন পাসপোর্ট ইস্যু বা নবায়ন ছাড়াও বিদেশি নাগরিকদের ভিসা সংক্রান্ত কাজেও বড় অঙ্কের ঘুস দিতে হয়। টাকা না দিলে হয়রানির শেষ নেই। বিশেষ করে বিভিন্ন কোম্পানিতে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের ভিসা নবায়ন, নো ভিসা ইত্যাদি কাজে বিভিন্ন রেটে ঘুস আদায় করা হয়। বিষয়টি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট।

জানা যায়, পাসপোর্ট অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যেও দুর্নীতিবাজরা ঘাপটি মেরে রয়েছেন। এ কারণে মাঠ পর্যায়ে অফিসগুলো থেকে বিপুল অঙ্কের ঘুসের টাকা পাঠানো হয় ঢাকার ‘হেড অফিসে’। ‘চ্যানেলের টাকা’ নামে পরিচিত ঘুসের এই বিশেষ তহবিল কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা হয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সাবেক এক সচিবও পাসপোর্ট থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের মাসোহারা নিতেন।

এ বিষয়ে একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তার নাম থাকায় অবসরে গিয়েও বেকায়দায় রয়েছেন তিনি। অবৈধ অর্থ সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। সূত্রমতে, ‘শ’ আদ্যাক্ষর নামের ওই সচিবের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ছায়া তদন্ত শুরু করেছে দুদক।

অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে বিদেশি মিশনগুলোয় পাসপোর্ট নবায়নে ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোর্ট নিয়ে অনেকেই চাকরি থেকে ছাঁটাই বা বরখাস্তের ঝুঁকিতে পড়েছেন। ফলে প্রবাসী শ্রমিকদের একটি অংশ যে কোনো মূল্যে পাসপোর্ট নবায়ন করতে মরিয়া। কিন্তু তারা ঢাকায় পাসপোর্ট অফিসে যোগাযোগ করে নবায়নের জন্য বড় অঙ্কের ঘুস দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

সূত্র বলছে, পাসপোর্টে বেশ কয়েকটি তথ্য সংশোধনের ওপর কড়াকড়ির কারণে ব্যাপক ঘুস বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে নাম, পিতা-মাতার নাম এবং জন্মতারিখ সংশোধনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার কারণে এসব বিষয়ে ঘুসের রেট খুবই চড়া। তবে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য এ ধরনের পাসপোর্ট করে নিতে অনেকে দালালদের কাছে ধরনা দেন। নাম অথবা জন্মতারিখ সংশোধনে মোটা অঙ্কের ঘুস নেওয়া হয়।

এছাড়া বই সংকটের কথা বলে পুরোনো এমআরপি (মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট) নবায়নের আবেদনই জমা নেওয়া হচ্ছে না। বর্তমানে এ ধরনের আবেদন পেন্ডিং রয়েছে ৫০ হাজারেরও বেশি। এ সুযোগে দালালচক্রের অবস্থা পোয়াবারো।

সূত্র বলছে, একেকটি এমআরপি নবায়নে সর্বনিম্ন ঘুস দিতে হচ্ছে অন্তত ৩০ হাজার টাকা। পেশাদার দালাল ছাড়াও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত আনসার সদস্যদের মাধ্যমে ঘুস লেনদেন হয়ে থাকে। দালালদের সঙ্গে লেনদেনের সময় কয়েকজন আনসার সদস্যকে নেমপ্লেট খুলে রাখতে দেখা যায়। অসাধু আনসার সদস্যদের বেশ কয়েকজনের নাম আসে যুগান্তরের কাছে। এছাড়া র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা থেকেও দুর্নীতিবাজ আনসার সদস্যদের তালিকা করা হয়েছে।

পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ূব চৌধুরী বিদেশে থাকায় দালাল দৌরাÍ্য ও কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিষয়ে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এদিকে সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, আগারগাঁও বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের বর্তমান পরিচালক মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলাম খান ঘুস সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত নন। তাকে এ পদে বসানো হয়েছিল দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য। কিন্তু দুর্নীতিবাজ চক্র খুবই প্রভাবশালী হওয়ায় তিনি অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তৌফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, প্রায় প্রতিদিনই তিনি দালাল চক্রের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। ইতোমধ্যে কয়েকজন দালালকে তিনি নিজের হাতে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছেন। র‌্যাবের অভিযানের কিছুদিন আগেও ডিবির সহায়তায় ৮/১০ জন দালালকে ধরা হয়েছে। দুর্নীতি বন্ধে তিনি সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

তথ্যসুত্রঃ দৈনিক যুগান্তর

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x