স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়াধীন জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে (আইপিএইচ) দুই বছর ধরে স্যালাইন ও ব্লাড ব্যাগ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ‘উৎপাদনের মানসম্মত চর্চা (জিএমপি) নেই’-এমন কৌশলী অভিযোগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে উৎপাদন।
উৎপাদন বন্ধ থাকায় বাক্সবন্দি স্যালাইন উত্পাদন প্ল্যান্টের কয়েক কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। দীর্ঘদিন অব্যবহূত থাকায় এসব যন্ত্রপাতি অকেজো হওয়ার পথে। বিষয়টি আমলে নিয়ে দ্রুত আধুনিকায়ন করে আইপিএইচের স্যালাইন উৎপাদন প্ল্যান্ট পুনরায় চালুর সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আইপিএইচে স্যালাইন উৎপাদন বন্ধের বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে কথা তোলেন কমিটির একাধিক সদস্য। তারা বলেন, আইপিএইচ সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্বল্পমূল্যে আইভি ফ্লুইড স্যালাইন সরবরাহ করছিল। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন বন্ধ থাকায় এর সুবিধা নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে ছয়-সাত গুণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ গুণ বেশি দামে একই স্যালাইন কিনতে হচ্ছে। অথচ ১২-১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কারখানাটি আধুনিকায়ন করে তিন মাসের মধ্যেই উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের আগস্টে বন্ধের আগে আইপিএইচের তৈরি ৫০০ সিসির এক প্যাকেট গ্লুকোজ স্যালাইন বিক্রি হতো ২৫ টাকায়। তখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একই স্যালাইন বিক্রি হতো ৬৫ টাকায়। আইপিএইচের উৎপাদন বন্ধ থাকায় এখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্যালাইনের দাম বেড়ে ৭০-৮০ টাকা হয়েছে। একইভাবে আইপিএইচের ১ হাজার সিসির স্যালাইন ৪২ টাকায় এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একই স্যালাইন বিক্রি হতো ৮০ টাকায়। এখন সেটি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। ৫০০ সিসির নরমাল স্যালাইন আইপিএইচ বিক্রি করত ২৫ টাকায়।
একই স্যালাইন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রি করত ৬৫ টাকায়। বর্তমানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তা বিক্রি করছে ৮০ টাকায়। ৩ শতাংশ সোডিয়াম ক্লোরাইড ৫০০ সিসির স্যালাইন আইপিএইচ বিক্রি করত ৪২ টাকায়। কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দেশে এই স্যালাইন তৈরি না করায় সেটি চোরাইপথে এনে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর জানায়, আইপিএইচের স্যালাইন কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে উৎপাদনের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এজন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার পরও সংশোধন না হওয়ায় লাইসেন্স স্থগিতের সুপারিশ করা হয়েছে। আইপিএইচের প্ল্যান্টটি আধুনিকায়ন ও স্বাস্থ্যসম্মত করা হলে পুনরায় উত্পাদনের অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে।
আইপিএইচে ৫০ বছর ধরে ২২ ধরনের স্যালাইন, ব্লাডব্যাগ, ট্রান্সফিউশন সেট উৎপাদন হচ্ছিল। এতে বছরে ১ লাখের বেশি ব্লাডব্যাগ তৈরি হতো, যা দেশের মোট চাহিদার সাত ভাগের এক ভাগ। উৎপাদন করত বিভিন্ন ধরনের ১৪ থেকে ১৭ লাখ স্যালাইন।
এসব স্যালাইন আইপিএইচ কম দামে সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করায় দামের প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছিল না স্যালাইন উৎপাদনকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, দেশের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে বরাদ্দের ৬১ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে ওষুধে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় আইভি ফ্লুইডে।
আইপিএইচের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হকের মতে-বন্ধ নয়, আইপিএইচের স্যালাইন কারখানাকে আধুনিকভাবে গড়ে তুলতে হবে। আর বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম সফিউজ্জামান মনে করেন, বিষয়টি সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। এখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ী করা ঠিক নয়।
আইপিএইচের সাবেক পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আব্দুর রহিম জানান, আইপিএইচের মূল কাঠামো ১৯৫৩ সালে স্থাপিত হলেও আইভি ফ্লুইড উত্পাদন ইউনিট ১৯৭২-৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নির্দেশনায় প্রতিষ্ঠিত। আইপিএইচে কলেরা স্যালাইন-১০০০ সিসি ও ৫০০ সিসি, গ্লুকোজ স্যালাইন-১০০০ সিসি ও ৫০০ সিসি, গ্লুকোজ অ্যাকোয়া স্যালাইন ১০০০ সিসি ও ৫০০ সিসি, নরমাল স্যালাইন ১০০০ সিসি ও ৫০০ সিসি, হেমোডায়ালাইসিস-১০০০ সিসি, হার্টসম্যান সলিউশন-১০০০ সিসি, ৩% সোডিয়াম ক্লোরাইড-৫০০ সিসি, স্যালাইন গিভিং সেট, ব্লাড ব্যাগ-৩৫০ সিসি ও ৪৫০ সিসি, ব্লাড ট্রান্সফিউশন অ্যান্ড ইনফিউশন সেট উৎপাদন করা হতো।
এছাড়া আইপিএইচে ডায়াগনস্টিক রিএজেন্ট ল্যাবরেটরিতে ২১ প্রকারের রি-এজেন্ট প্রস্তুত করা হতো। দেশের সব সরকারি হাসপাতালে স্বল্পমূল্যে এগুলো সরবরাহ করত আইপিএইচ। তবে উৎপাদন বন্ধ থাকায় স্যালাইন, ব্লাড ব্যাগ ও রি-এজেন্ট উৎপাদনের কাজে ব্যবহূত বিভিন্ন কাঁচামাল, ফিনিশ্ড প্রডাক্ট প্রচুর পরিমাণে মজুত আছে এবং ঐসব পণ্য উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত দক্ষ জনবল বর্তমানে কর্মহীন।
এদিকে, আগামী ছয় থেকে ৯ মাসের মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশে করোনার টিকা বোতলজাত শুরু করারও তাগিদ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। বৈঠকে দেশে করোনার টিকা উৎপাদনের বিষয়ে সংসদীয় কমিটিও একটি কমিটি গঠন করেছে। দেশে সরকারিভাবে করোনা ভাইরাসের টিকা উৎপাদনে একটি পূর্ণ পরিকল্পনার বিষয়ে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে এই কমিটিকে সুপারিশ করেছে স্থায়ী কমিটি।