ঢাকা, রবিবার ২৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০১:৩৪ অপরাহ্ন
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: বিধবা পুনর্বিবাহ আন্দোলন
ভাস্কর সরকার (রাবি):
বিধবা বিবাহ স্রেফ দুটি শব্দ। এই দুটি শব্দই কাঁপিয়ে দিয়েছিল তৎকালীন সমাজকে। কেউ কেউ তো বলেই বসেছিলেন যে সমাজ নাকি রসাতলে গেলো! হিন্দু ধর্ম উচ্ছন্নে গেলো! কত বিতর্ক, কত বিদ্রুপ। কেউ পক্ষে তো কেউ বিপক্ষে। কেউ আবার নির্লিপ্ত। কিন্তু তখনকার সমাজে বিধবা হওয়া মাত্র যাদের জীবনে নেমে আসতো বন্দিদশার অভিশাপ, ধর্মের করাল কুঠার; তাঁরা পেয়েছিলেন এক ঝলক টাটকা বাতাস, মুক্তির স্বাদ, নতুন করে বাঁচার আশ্বাস, ‘পাপ’ নামক বস্তুটি থেকে মুক্তি। বাংলা সাহিত্যের প্রসার, সংস্কৃত সাহিত্যের সহজসরল অনুবাদ নারী শিক্ষা বিস্তারে বহু প্রবন্ধ লিখে সমাজে আলোড়ন তুলেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। নারীর সম্মান ও আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন তিনি। সমাজে বিধবা বিবাহ প্রচলন করে বিদ্যাসাগর বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
হিন্দু বিধবাদের পুনরায় বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকে বিধবা বিবাহ বলে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সমাজসংস্কারের জন্য যে কয়টি আন্দোলন ইতিহাসের পাতায় এখনো জ্বলজ্বল করছে, তার অন্যতম হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আন্দোলন। সে সময় অবাধে বাল্যবিয়ের ব্যাপক প্রচলন ছিল। ফলে একদিকে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিল; অন্যদিকে সমাজে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিল বিধবার সংখ্যা। বিষয়টি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মনে রেখাপাত করে। তিনি হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহের জন্য সমাজসংস্কার আন্দোলন সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল পান ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই। সেদিন তাঁর প্রচেষ্টায় তৎকালীন বড়লাট লর্ড ডালহৌসি ‘দ্য হিন্দু উইডো’স রিম্যারেজ অ্যাক্ট ১৮৫৬’ নামে আইন প্রণয়ন করে হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহকে বৈধ করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখন বেশ ছোট। তাঁর ছোটবেলায় এক খেলার সঙ্গী ছিলেন, যাঁর নাম রাইমণি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রাইমনিকে খুব ভালোবাসতেন। খুব অল্প বয়সে রাইমণির বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু বিধির বিধান, কিছু বছর পরেই রাইমণির স্বামী মারা গেলে বিধবা রাইমণি তাঁর নিজ গ্রাম বীরসিংহে পিত্রালয়ে ফিরে আসেন, সঙ্গে নিয়ে আসেন তাঁর একমাত্র সন্তান গোপালকে। বিদ্যাসাগর একদিন গ্রামে ফিরে রাইমণিদের বাড়িতে তাঁর খোঁজ নিতে যান। তিনি সেখানে গিয়ে দেখেন রাইমণি শুকনা মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। একাদশীর সেই দিনে রাইমণি উপবাস করেছিলেন। তাঁর মুখাবয়বজুড়ে ছিল উপবাসের করুণ চিহ্ন। রাইমণির করুণ অবস্থা দেখে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের খুব কান্না পেয়েছিল এবং সেই সঙ্গে বিদ্যাসাগরের মনে আগুন জ্বলছিল। বিদ্যাসাগরের মনে হয়েছিল হিন্দু বাল্যবিধবাদের বৈধব্যের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন বিধবাদের পুনর্বিবাহ।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর বাবা ঠাকুরদাসের সঙ্গে গ্রামের নানা রকম সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় বিদ্যাসাগরের মা ভগবতী দেবী সেখানে এসে পুত্রের কাছে বিধবাদের বাঁচার উপায় জানতে চাইলেন। তিনি বলেন, ‘তুই এত দিন যে শাস্ত্র পড়িলি, তাহাতে বিধবাদের কোনো উপায় আছে কি না?’
ভগবতী দেবী অকালবিধবা পড়শী কিশোরীদের দুঃখে আকুল হতেন। মায়ের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের বাবা ঠাকুরদাসও ছেলের কাছে একই সমস্যার সমাধানের উপায় জানতে চাইলেন, ধর্মশাস্ত্রে বিধবাদের প্রতি শাস্ত্রকারেরা কী কী ব্যবস্থা করেছেন? অকাল বিধবাদের দুঃখ তাঁকেও স্পর্শ করত। মা–বাবার প্রশ্নের উত্তরে বিদ্যাসাগর জানালেন, এমন বিধবাদের বিয়ে শাস্ত্রসিদ্ধ। এ বিষয়ে তাঁর বই লেখার ইচ্ছা আছে। আমাদের সমাজ কুসংস্কারের কারণে প্রথাবিরোধী। বিদ্যাসাগরও সমাজ বিরোধের আশঙ্কায় দ্বিধাগ্রস্ত। বাবা ঠাকুরদাস ও মা ভগবতী দেবী দুজনেই ছেলেকে এগিয়ে যেতে বললেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন, সমাজের শাস্ত্রের গোঁড়ামি শাস্ত্র দিয়েই ভাঙতে হবে।
বিদ্যাসাগরের মাথায় তখন একটাই চিন্তা, বিধবাদের পুনর্বিবাহ। এই সময় তিনি সংস্কৃত কলেজের পাঠাগারে সারা দিন ধরে নানা পড়া শুরু করলেন। বিরতি নিতেও যেন তাঁর মন চায় না। পাঠের মাঝে বিরতি শুধু খাবারের। একদিন পড়তে পড়তে তিনি আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। তিনি পেয়ে গেছেন পরাশর সংহিতার দুই লাইনের শ্লোক।
‘নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে, ক্লীবে চ পতিতে পতৌ’ অর্থাৎ—
‘স্বামী নিখোঁজ হলে বা তার মৃত্যু হলে, নপুংসক আর পতিত হলে তাঁর স্ত্রী পুনরায় বিয়ে করতে পারেন।’
খুশি খুশি মনে এই যুক্তির ওপর ভর করে তিনি বিধবাদের বিয়ের পক্ষে দুটি বই লিখলেন। এ ছাড়া বিধবাবিবাহের পক্ষে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি অব্যাহত তো ছিলই। তিনি লিখলেন, ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ, যা ১৮৫৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৮৫৫ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয় ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না, এই বিষয়ক প্রস্তাব’। এরপরই প্রবল আলোড়ন শুরু হয়।
বিধবা বিবাহের বিরোধিতা করে পন্ডিত রাধাকান্ত দেব কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে পণ্ডিতসভা ডাকলেন। সেখানে তীব্র বাদানুবাদ হল বিদ্যাসাগর ও পণ্ডিত ব্রজনাথ বিদ্যারত্নের মধ্যে। বিদ্যাসাগর শাস্ত্রের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন পণ্ডিতরা তা প্রমাণ করার জন্য জোর সওয়াল করলেন। তবুও ব্যর্থ হলেন তাঁরা। রাধাকান্ত দেব এই বিধবা বিবাহে সমর্থন না করলেও বিদ্যাসাগরের যুক্তিতে মুগ্ধ হয়ে এক জোড়া শাল তাঁকে দেন।
১৮৫৫ সালের জানুয়ারিতে বিধবা-বিয়ে নিয়ে লেখা বিদ্যাসাগরের বইয়ের প্রথম সংস্করণের দু’হাজার কপি মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে গেল। উৎসাহিত বিদ্যাসাগর আরও তিন হাজার বই ছাপালেন। সংস্কারাচ্ছন্ন পণ্ডিতেরা তাঁর বিরুদ্ধ সমালোচনা শুরু করলেন। বিভিন্ন সংবাদপত্রে ঈশ্বরচন্দ্রের মতের বিরুদ্ধে অসংখ্য চিঠি প্রকাশিত হতে শুরু করল। পাল্টা জবাব দিলেন বিদ্যাসাগর। বইটি সারা ভারতবর্ষে জুড়ে ঝড় তুলেছিল। বিদ্যাসাগরকে আরও দশ হাজার কপি ছাপাতে হয়েছিল। ১৮৫৫ সালের অক্টোবর মাসে ৯৮৬ জনের সই নিয়ে বিদ্যাসাগর সরকারের কাছে বিধবা বিবাহের দাবি পেশ করলে দেশ জুড়ে বিতর্কের ঝড় উঠল।
১৮৫৬ সালে বর্ধমান থেকে বিধবাবিবাহের সমর্থকেরা আরেকটি আবেদনপত্র সরকারকে দেওয়া হলে বর্ধমানের রাজা মহতাব চাঁদ বিদ্যাসাগরের সমর্থনে সই করেন। প্যারীচাঁদ সরকার, প্যারীচাঁদ মিত্র, রাজনারায়ণ বসু, কিশোরীচাঁদ মিত্র, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখ বিদ্যাসাগরের সমর্থনে সরকারের কাছে আবেদন পাঠালেন। সমর্থনের চেয়ে বিরুদ্ধ দরখাস্তের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রায় ৩০ হাজার প্রতিবাদপত্র সরকারের কাছে জমা পড়ল। এমন সাবধানবাণীও প্রচারিত হলো, বিধবাবিবাহ চালু হলে ভারতে নিশ্চিত ধর্মদ্রোহ হবে। বিদ্যাসাগরের যুক্তির কাছে বিরোধীরা হার মানতে বাধ্য হন। তবু তাঁরা বিদ্যাসাগরের কাজের বিরোধিতা চালিয়ে যেতে থাকেন।
সব প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই বিধবাবিবাহ আইন পাস হলো। বিধবাবিবাহ আইন পাসের পেছনে গ্র্যান্ড সাহেবের অবদানকে সম্মান জানিয়ে বিদ্যাসাগর গ্র্যান্ড সাহেবের বাংলোয় গিয়ে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসেন। বঙ্গদেশে নতুন যুগের সূচনা হলো। এত দিন যারা সমাজের গোঁড়ামির ভয়ে এগিয়ে আসেনি, তারাও তাদের সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আসে। আইন পাস হলো কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটি বাঁধবে কে? মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে অর্থবলের প্রয়োজন হয়। বিদ্যাসাগর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি নিজের মাস্টারমশাই প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘বিধবার বিয়ে হবে, আমিই দেব।’ বিদ্যাসাগর বিস্তর খরচ করে প্রথম বিধবাবিবাহের জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর রাতের দ্বিতীয় প্রহরে পাত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের সঙ্গে বিধবা পাত্রী ১০ বছরের কালীমতির বিয়ে দিয়ে ইতিহাস রচনা করেন। বিদ্যাসাগর কনের মা লক্ষ্মীদেবীকে দিয়ে কন্যা সম্প্রদান করালেন। বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে সোনার জলে লেখা থাকল বিধবাবিবাহের প্রথম আয়োজনের তারিখটি।
বিধবাবিবাহের প্রবর্তক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিজের একমাত্র ছেলে নারায়ণ চন্দ্রের বিয়ে ভবসুন্দরী নামের বিধবা কন্যার সঙ্গে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি শুধু কথায় নয়, কর্মেও পারঙ্গম।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পিছিয়ে থাকা নারীসমাজকে পথ দেখিয়েছিলেন। ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই বিধবাবিবাহ আইন পাস হওয়ার পরও তিনি নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন বিধবাদের বিবাহের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে। তিনি হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ড প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিধবাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্য সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি সামাজিক রক্ষাকবচ প্রাপ্তি বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত পরিশ্রমের অবদান। তাঁর ছিল কঠিন সংগ্রামী জীবন। অন্যায়ের সঙ্গে তিনি কখনো আপস করেননি। বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, ‘আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি, নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ হইবে, তাহা করিব, লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সংকুচিত হইব না।’
লেখক,
গবেষক ও প্রাবন্ধিক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
x