ঢাকা, সোমবার ২০ মে ২০২৪, ১২:১৫ অপরাহ্ন
দখল দুষন আর ভরাটের কারনে অস্তিত্ব হারাচ্ছে চলনবিল
Reporter Name
বিপর্যয়ের মুখে নদী অঞ্চলের প্রায় ৫০ লাখ মানুষ অস্তিত্ব হারাচ্ছে চলনবিল ও নদ-নদী

শরিফুল ইসলাম-গুরুদাসপুর (নাটোর) প্রতিনিধি: দখল দুষন আর ভরাটের কারনে অস্তিত্ব হারাচ্ছে চলনবিল। সেই সাথে চলনবিল কেন্দ্রিক প্রধান নদী আত্রাই, নন্দকুঁজা ও গুমানী, বড়ালসহ ১৬ টি নদ-নদী প্রায় মৃত হয়ে গেছে। ফলে নদী এলাকার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বড়াল রক্ষা আন্দোলন ও চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটি ইতি মধ্যে মানববন্ধনও করেছে। প্রমত্তা পদ্মার শাখা নদী বড়াল রক্ষা, দখলমুক্তকরণ, বাঁধ অপসারণ, পুনঃখনন ও ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় আনার দাবি জানায়।

ইম্পেরিয়েল গেজেট অব ইন্ডিয়া বই থেকে জানা যায়-চলনবিল অঞ্চলে ১৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, ৪২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গ কি.মি. আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাল রয়েছে। এরমধ্যে প্রধান নদী ৯টি, ২০টি খালসহ ছোট ছোট বিভিন্ন বিল ও খাল রয়েছে। অতীতে ২৩ হাজারের মত বড় বড় পানির আধার ছিল। যা বেশীর ভাগই বেদখলকৃত ও হাত ছাড়া হয়ে গেছে।

নদীগুলোর মধ্যে আত্রাই, নন্দকুঁজা, গুমানী, গুড়, করতোয়া, বড়াল, তুলসি চেঁচিয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা ইত্যাদি। ১৮টি খালের মধ্যে নবীরহাজির জোলা, হকসাহেবের খাল, নিমাইচড়াখাল, বেশানীরখাল, গুমানীখাল, উলিপুরখাল, সাঙ্গুয়াখাল, দোবিলাখাল, কিশোরখালির খাল, বেহুলারখাড়ি, বাকইখাড়া, গোহালখাড়া, গাড়াবাড়ি খাল, কুমারভাঙ্গাখাল, জানিগাছার জোলা, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর।

ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে-জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারনে ফারাক্কার বিরুপ প্রভাব ও ৮০’র দশকে পদ্মার উৎস মুখে অপরিকল্পিত স্লুইসগেট নির্মানের ফলে চলনবিলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত বিভিন্ন নদ-নদী ও বিল, জলাশয়, খালগুলোতে পলি জমে ক্রমশঃ ভারাট হয়ে গেছে। তাছাড়া বিলের মাঝ দিয়ে যথেচ্ছা ভাবে সড়ক, ব্রীজ-কালভার্ট, নদী দখল করে বসতি, দোকান পাট স্থাপন করায় নদীগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। পানির স্তর নিচে নামতে নামতে এমন অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এখন নদীগুলো ৪/৫ মাসের বেশী পানি থাকে না। শুকনো মওসুমে টিউবয়েল ও শ্যালোমেশিনে পানি পাওয়া যায়না। ফলে খাবার ও ইরিগেশনে সেচ দেওয়ার পানি পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড.মো. রেদওয়ানুর রহমানের প্রবন্ধ থেকে পাওয়া তথ্যে জানাগেছে-  প্রায় ২৫ বছর আগেও চলনবিলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীতে বছর জুড়েই ৬-১২ ফুট পানি থাকত। ফলে বছর জুড়েই নৌচলাচল করতো। কিন্তু বছরের পর বছর পলি জমে এসব নদী ভরাট হয়ে গেছে। পরিসংখ্যানমতে, প্রতি বছর ২২২ ১/২  মিলিয়ন ঘনফুট পলি প্রবেশ করে ৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট পলি বর্ষায় চলনবিলে ত্যাগ করে। অবশিষ্ট ২৬৯ ১/২  মিলিয়ন ঘনফুট পলি নদ-নদীসহ চলনবিলে স্থিতি থাকে।

পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ডা. আব্দুল মতিন, বড়াল রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়কারি আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মিজানুর রহমান জানান,- দেশের বৃহত্তম পদ্মা-যমুনা নদী এবং জলাভুমি বিশাল চলনবিলের মধ্যে প্রধান সংযোগ নদী হচ্ছে বড়াল।

এই নদী ৪টি জেলা ও ৮টি উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। রাজশাহীর চারঘাট থেকে উৎপত্তি হয়ে চলনবিলের মধ্যে দিয়ে মুশাখা, নন্দকুজা, চিকনাইসহ বেশ কয়েকটি নদীর জন্ম দিয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ির হুড়াসাগর হয়ে যমুনায় মিলিত হয়েছে। এক সময় এই নদী ছিল প্রবহমান। কিন্তু ৮০’র দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ড অপরিকল্পিত ভাবে নদীর উৎস মুখ ও ৪৬ কিলোমিটার ভাটি এলাকার আটঘরিয়ায় স্লুইসগেট নির্মান, পাবনার চাটমোহরে তিনটি ক্রস বাঁধ ও স্লুইসগেট  নির্মানের কারনে প্রমত্তা বড়াল বর্তমানে পকুরে পরিনত হয়েছে। এছাড়া কয়েকটি শিল্প কারখানার তরল বর্জ্য পানি দুষন সহ ভুমি দস্যুদের কবলে পড়ে বিলিন হয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, একটি স্বার্থান্বেষী মহলের যোগসাজসে বড়াল নদীকে অবক্ষয়িত জলাশয় ঘোষনা করে খনন করে দখলে নেয়। ফলে নদীর সংলগ্ন এলাকায় ফসলহানি, বদ্ধ পানিতে দুষন-র্দুগন্ধ-রোগবালাই, জেলে-কৃষক, ব্যবসায়ীরা বেকার ও দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ভুমি দস্যুরা দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখায় নদী তীরবর্তী জেলে ,কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বেকার বানিয়ে নদী ধংসের অপকর্মে নেমেছে। ব্যবস্থাপনার নামে অকেজো হয়ে পড়া স্লুইসগেটগুলো এখন সরকারী টাকা অপচয়ের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব জেনেশুনে সংশ্লিষ্ট বিভাগ নিরব রয়েছে। বড়াল নদীকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দাবী করেছে নদীর তীরবর্তী মানুষ।

বড়াইগ্রাম বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব ডিএম আলমগীর জানান, বড়াল নদী চালু ও তা রক্ষার জন্য বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বড়াল রক্ষা আন্দোলন, চলনবিল রক্ষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগঠন, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও সর্বস্তরের মানুষ গত ২০০৮ সাল থেকে আন্দোলনে নামে। নাটোর, পাবনা ও রাজশাহীর সংসদ সদস্যরাও ওই আন্দোলনে একাত্তা ঘোষনা করেন।

পরবর্তীতে জনদাবীর মুখে পানি উন্নয়ন বোর্ড টাস্কফোর্স গঠন করে। নদী বিষয়ক টাস্কফোর্স এবং ভুমি মন্ত্রনালয়ের সংসদীয় কমিটির সভায় বড়াল নদীর সব বাধা অপসারন করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। কিন্তু বাস্তবে নদী উদ্ধারে কিছুই করা হয়নি। বড়াল নদীর ওপর নির্মিত সকল স্লুইসগেট-বাঁধ অপসারন করে সেখানে প্রস্থ সেতু নির্মান করা সহ নদীর সীমানা চিহ্নিত ও দখলদার উচ্ছেদ করে অচল নদী সচল করতে এই আন্দোলণ।

বড়াল রক্ষা আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব মিজানুর রহমান জানান, ১৯৮৫ সালে ২০ হাজার কিউসেক পানি স্বাভাবিক প্রবাহ থাকার সময় পানি  উন্নয়ন বোর্ড বড়াল নদীর উৎসমুখ  চারঘাট এলাকায় ৬ হাজার কিউসেক  পানি প্রবাহের স্লুইসগেট নির্মান করে।

নাটোর-৪ (গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম) আসনের সাংসদ আব্দুল কুদ্দুস বলেন,- চলনবিলসহ বড়াল নদীকে রক্ষা করতে পারলে উত্তরের ৮ উপজেলার অর্ধকোটি মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাত্রা অব্যহত থাকবে। বেকারত্ব থেকে মুক্তি পাবে অন্তত পক্ষে ১০ লাখ মানুষ। তাই নিজেদের স্বার্থে চলনবিল ও বিলের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো রক্ষায় সোচ্চার হচ্ছে মানুষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x