ঢাকা, বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৩৬ পূর্বাহ্ন
কুচিয়া মাছ নিয়ে গবেষণায় রাবির ফিশারীজ বিভাগ প্রদর্শন ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন
ভাস্কর সরকার (রা.বি):

কুইচা বা কুঁইচা, কুঁচে মাছ, কুচিয়া, কুইচ্চা বা কুচে বাইম (ইংরেজি: Asian swamp eel) একটি ইল-প্রজাতির মাছ। Sybranchidae পরিবারের অন্তর্গত এই মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Monopterus cuchia । বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের রক্ষিত বন্যপ্রাণীর তালিকার তফসিল ২ অনুযায়ী এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।

কুচিয়া মাছের নাম শোনেনি এমন মানুষ মেলা ভার। কুঁচে বা কুইচ্চা নামেও পরিচিত সর্পিলাকার লম্বা এই মাছটি। এই মাছ অধিক স্বাদযুক্ত, পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ, ঔষধিগুণসম্পন্ন, মূল্যবান, রপ্তানীযোগ্য, বেশ শক্তিশালী, দূষণ প্রতিরোধী, নিশাচর ও মাংসাশী। বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত, পাকিস্থান ও মায়ানমারের কিছু অংশে মাছটি পাওয়া যায়।

এই মাছ পুকুর, খাল, নদী, বিল, ঝিল, হাওড়, বাওড়, প্লাবনভূমি, গর্ত ও বেশী কাদাযুক্ত অগভীর জলাশয়ে এবং বন্যার সময় ধানের জমিতেও পাওয়া যায়। কুচিয়া মাছ শিকারী হিসাবে পরিলক্ষিত হয় যা রাতে ছোট মাছ, উভচর, ক্রাস্টেসিয়ানস, ইকিনোডার্মস, পোকার লার্ভা, জলজ ইনভার্টেব্রেটস শিকার করে খায় ও বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা য়ায় যে, মাছটি কেঁচো, টিউবিফেক্স, শামুক, জলজ পোকামাকড়, পোকামাকড়ের পিউপি, কসাইখানার বর্জ্য (যকৃত, অন্ত্র, ভিসেরা, পশুপাখির চামড়া), মরা ছোট মাছ , পিলেট খাদ্য ও জলজ জীবন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রানিদের খায়।

উপজাতি, হিন্দু, খ্রিস্টান সম্প্রদায় ছাড়া মাছটি খাদ্য হিসেবে বাংলাদেশে ততটা জনপ্রিয় না হলেও দেশের বাইরে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় এবং বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে খাওয়া ও প্রস্তুত করা হয়। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, জাপান, কোরিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, হংকং, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ ইত্যাদি জাতীয় দেশে এই মাছের প্রচুর চাহিদা রয়েছে , রয়েছে অপার সম্ভাবনা।

তথ্যসূত্র হতে জানা যায় ভারতে ১৯৭৭ সালে কুচিয়ার রক্তের বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ করা হয়। এরপর ১৯৮৯ সালে কোলকাতা হতে কুচিয়া সুইডেনে নিয়ে গিয়ে দেখা হয় এর শ্বষনতন্ত্রের গঠন। ২০০০ সালের দিকে মাছটিকে বিপদাপন্ন ঘোষণা করে প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য আর্ন্তজাতিক ইউনিয়ন। তাই এই মাছটি সংরক্ষণে গবেষণা হয়ে পড়ে অপরিহার্য। বাংলাদেশের গবেষণা মহলেও শুরু হয় এই মাছ নিয়ে প্রাথমিক চিন্তা ভাবনা। যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে ২০০৩ সালে কুচিয়ার উৎপাদনের উপর বিভিন্ন খাবারের প্রভাব পরীক্ষা করে দেখা হয়।

একই সালে বাকৃবিতে কুচিয়ার উৎপাদনের উপর বিভিন্ন বাসস্থানের (যেমনঃ কাদা, কচুরিপানা, পিভিসি পাইপ, ডিচ) প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা হয়। তারপর ২০০৫ সালে কুচিয়ার শরীরবৃত্তীয় বৃদ্ধির উপর তাপমাত্রার প্রভাব নিয়ে গবেষণা চলে।এরপর ২০০৮ সালে ঢাবিতে কুচিয়ার জীবতত্ত্বের উপর চলে গবেষণা। পাশাপাশি দেখা হয় কুচিয়া মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন এবং এর পোনার শরীরবৃত্ত্বীয় বৃদ্ধির ধরণ। ২০১০ সালে উত্তরবঙ্গে উপজাতিদের কুচিয়া চাষের পদ্ধতির উপর গবেষণা পরিচালিত হয় । একই সালে ভিয়েতনামে কুচিয়ার লার্ভা ও বেড়ে ওঠা বিষয় নিয়ে গবেষণা চলে ।

এরপর ২০১২ সালে নোয়াখালিতে কুচিয়া মাছের বিপনন ও রপ্তানীর বিভিন্ন দিক নিয়ে চলে গবেষণা। তারপর ২০১৫ সালে শাবিপ্রবিতে কুচিয়া মাছের গৃহস্থালি চাষ পদ্ধতির উপর গবেষণা চালানো হয়। কুচিয়ার উপর করা গবেষণাগুলো মূলত সিমেন্টের সিসটার্নস, ট্যাঙ্ক, ডিচ, ধানের ক্ষেতে করা হয়েছিল বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা এবং সিলেট অঞ্চলে।

তবে বিভিন্ন মজুদ ঘনত্বের অধীনে পুকুরে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কুচিয়ার উন্নত চাষ সম্পর্কিত কোনও পর্যাপ্ত পদ্ধতি তখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি ২০২১ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল অফ জুয়োলজিতে প্রকাশিত হয় বিভিন্ন ঘনত্বে কুচিয়া চাষের উপযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশী গবেষকদের করা সমন্বিত গবেষণা।

সেই দলে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে গবেষণা দলটির মূখ্য গবেষক ও সম্পাদক স্বপন কুমার বসাক, সহযোগী গবেষক আলোক কুমার পাল, মোঃ নাজিম উদ্দিন , পিকেএসএফ থেকে এ এম ফারহাদুজ্জামান , বাকৃবি থেকে মোঃ মজিবর রহমান , দক্ষিণ কোরিয়া থেকে উসমান আতিক , লাহোর থেকে সোনিয়া ইকবাল, চিন থেকে এম শাহানুল ইসলাম প্রমুখ। মূখ্য গবেষক ও সম্পাদক স্বপন কুমার বসাক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারীজ বিভাগের ১১ তম বাচের শিক্ষার্থী । বর্তমানে তিনি সেন্টর ফর এ্যাকশন রিসার্চ বারিন্দ  “সিএআরবি” সংস্থায় মৎস্য কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। এটি ছাড়াও তার আরও ৩টি গবেষণা প্রবন্ধ ও ৩টি বৈজ্ঞানিক পোস্টার প্রকাশিত। তিনি জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ ও সহযোগীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

গবেষণাটির সুপারভাইজর উত্তরবঙ্গের কুচিয়া চাষের পথিকৃত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারীজ বিভাগের প্রফেসর মোহাঃ আখতার হোসেন ।

গবেষণাটিতে কোন ঘনত্বে কুচিয়ার চাষ অর্থনৈতিক দিয়ে লাভজনক তাও খতিয়ে দেখা হয়। গবেষণাতে উঠে আসে বেশি ঘনত্বে (হেক্টরে ২০ হাজার পোনা) কুচিয়া চাষ করে মাছের মোট উৎপাদন পরিমান ও মোট আয় বাড়লেও মাছের আকার ছোট হয়, দেহবৃদ্ধির হার কমে, প্রাথমিক ব্যয় বেড়ে যায় ও পানির গুনগতমান তুলনামুলকভাবে বেশি খারাপ হয় ।

অন্যদিকে কম ঘনত্বে চাষ করে খাদ্য ও আবাসের জন্য প্রতিযোগিতা করতে হই নাই বলে কুচিয়া মাছ বেশ বড় হয়েছে, দ্রুত দেহবৃদ্ধি হয়েছে ও বিক্রির পর বিশ্লেষণ করে দেখা যায় মাছপ্রতি লাভের পরিমাণও বেড়েছে। সামগ্রিকভাবে, বর্তমান অনুসন্ধানের ভিত্তিতে, সর্বোচ্চ দেহবৃদ্ধির কর্মক্ষমতা, বেঁচে থাকা, অর্থনীতি ও উপযুক্ত পানির গুণগতমান কম মজুদ ঘনত্বে তুলনামুলকভাবে উত্তম ফলাফল প্রদর্শন করেছে।

এজন্য প্রতি হেক্টরে ১০ হাজারের বেশি পোনা ছাড়া ঠিক নয় বলে জানিয়েছেন গবেষণা দলটির মূখ্য লেখক স্বপন কুমার বসাক। এছাড়াও মে-জুন মাসে কুচিয়া যেকোনো জলাশয়ে পোনা উৎপাদন করে থাকে তাই কম ঘনত্বে চাষ করলে কুচিয়া পোনাগুলো বড় হওয়ার সুযোগ পাবে । অর্থনৈতিকভাবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও বিপদাপন্ন মাছটির চাষ পদ্ধতির উন্নয়নে আরও গবেষণা চালানো উচিত বলে মনে করেন তিনি।

গত ২২ জুন, ২০২১ এই গবেষণাটি জাগাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ক্লাব আয়োজিত বৈজ্ঞানিক সভাতে পোস্টার প্রদর্শন ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মহাপরিচালক মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান ক্লাবের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহেদুর রহমান এবং উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ।

এই প্রতিযোগিতায় পোস্টারটি সকলের সামনে প্রদর্শন করেন এক সহযোগী গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সমুদ্র গবেষক ড. এম শাহানুল ইসলাম। তার বক্তব্য হতে জানা যায় প্রকৃতিতে আশংকাজনকহারে কমে যাচ্ছে কুচিয়া মাছ যার রপ্তনীমূল্য অনেক। তাই প্রায়গিক চাষের মাধ্যমে মৎস্যচাষীদের অর্থনৈতিক সুদিন এবং অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করে মাছটি রপ্তানীর মাধমে দেশের অগ্রগতি তরান্বিত করতেই পরিচালনা করা হয় এই গবেষণাটি। এছাড়াও কৃত্রিম চাষ বৃদ্ধি পেলে প্রকৃতিতে কুচিয়া মাছের সংখ্যাও বেড়ে যাবে। ফলে এই মাছ সংরক্ষণেও কাজে লাগবে আধা-নিবিড়ভাবে সম্পন্ন এই গবেষণাটি।

2 responses to “কুচিয়া মাছ নিয়ে গবেষণায় রাবির ফিশারীজ বিভাগ প্রদর্শন ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন”

  1. … [Trackback]

    […] Find More on on that Topic: doinikdak.com/news/30080 […]

  2. … [Trackback]

    […] Here you can find 85258 more Info to that Topic: doinikdak.com/news/30080 […]

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x