ঢাকা, সোমবার ১০ মার্চ ২০২৫, ০৩:০৬ অপরাহ্ন
প্রসঙ্গ: বাউল নৃত্য
ভাস্কর সরকার (রাবি প্রতিনিধি)

বাউল ত্রকটি শাস্ত্র বর্জিত লৌকিক ধর্ম সম্প্রদায়। সাংখ্য, তন্ত্র, যোগ, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব সহজিয়া, সুফি মতের সংমিশ্রনে বাউল ধর্মমতের সৃষ্টি। শাস্ত্রের কঠিন অনুশাসন বাউলধর্মকে প্রভাবিত করতে পারেনি। তবে এ ধর্মে তত্ত্ব ও দর্শন আছে, সাধন পদ্ধতি আছে, সাধক জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা আছে, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে বাউলদের একটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আর এ সমস্ত বিষয়াদি ব্যক্ত হয় তাঁদের গানে। গানকে কেন্দ্র করেই বাউলের পথ চলা। তাই তো তাঁরা বলেন ‘গানই জ্ঞান’৷ অর্থাৎ গানের মধ্যেই বাউল ধর্মের মূলমন্ত্র। তাঁরা ধর্মসাধনার মন্ত্র হিসাবে গান গায় এবং সেই গানের অনুসঙ্গে আসে বাদ্য ও নৃত্য। গীত, বাদ্য, নৃত্যের সমাহারে বাউল খুঁজে ফেরে তাঁর মনের মানুষ ,অলখ সাঁই, ভাবের মানুষ, অচীন পাখি, পরমাত্নাকে।

এক :

বাউল নৃত্য ও সংজ্ঞা : মানুষের নৃত্যের ইতিহাস হাজার বছরের। উৎস খুঁজতে গিয়ে ড. পল্লব সেন গুপ্ত বলেন,

‘‘ আজ অবধি সবচেয়ে পুরোনো নাচের ছবি পাওয়া গেছে, তার বয়স কম বেশি ২০,০০০ বছর। দক্ষিণ ফ্রান্সের আরীজ্ অঞ্চলের বিভিন্ন পাহাড়ে বেশ কিছু প্রাগৈতিহাসিক চিত্রগুহা খুঁজে পাওয়া গেছে , যাদের একটি হল ‘ ত্রোয়া ফ্লের  বা, তিনভাই ; (তিনটি ভাই মিলে খেলা করতে করতে ঐ গুহাটি খুঁজে পেয়েছিল বলে এই নাম করন !),  তার প্রবেশ পথের মুখে নানারকমের প্রানীর ছাল, চামড়া, শিং ইত্যাদি সেজেগুজে একজন নৃত্যরত মানুষের ছবি আঁকা আছে। এইটিই প্রাপ্ত প্রাচীনতম ছবি, যাতে নাচের ভঙ্গীতে কোন মানুষকে দেখা যাচ্ছে।’ ১

এছাড়া বাংলার প্রাচীন লোকদেবতা ‘শিবকে নর্তক হিসাবে পাওয়া যায়। যে নৃত্যের সময় ধরণী কেঁপে উঠেছিল। শিবের নৃত্যকে ‘তান্ডব নৃত্য’ বলা হয়েছে। আবার মনসা মঙ্গলে বেহুলা স্বর্গ দেবতার সামনে নৃত্য প্রদর্শন করে স্বামীকে ফিরে পেয়েছিল। সুফি সাধকগণ জিকিরের সুর-ছন্দ-তালে পরমাত্নাকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। কেননা মানবদেহের সাথে নৃত্যের ছন্দ ও তালের একটা সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের শরীরে প্রবাহমান রক্ত একই ছন্দ ও তালে ধাবিত হয়। এছাড়া আমাদের চোখ নাচে, পা নাচে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নাচে। দেহের ছন্দ ও তালের সাথে যখন কন্ঠে সুর যোগ হয় তখন দেহ-মন হারিয়ে যায় অনন্ত অসীমে। চৈতন্যদেবও নৃত্যের মাধ্যমে কীর্ওন গান প্রচার করেছেন। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চযার্পদেও ডোম্বীর নৃত্যের কথা উল্লেখ আছে ৷

“এক সো পদ্ম চৌষঠঠী পাখুড়ী ।

তাই চড়ি নাচঅঁ ডোম্বী বাপুড়ী ।” ২

তাই বলা যায়, নৃত্যের সাথে ধর্ম ও জাদু সংস্কারের একটি যোগ রয়েছে। আদিম মানুষের গুহায় অংকিত চিত্র মূলত জাদু বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে। প্রাণীর ছাল-চামড়া-শিং ইত্যাদি দিয়ে সেজেগুজে নৃত্যরত মানুষের অংকিত চিত্রে জাদুর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আদিম মানুষের বিশ্বাস ছিল শিকারের জন্য কৃত্রিম উপায়ে বন্যজন্তু সাজলে হিংস্র প্রাণী আর আক্রমণ করবে না। আবার লোকদেবতা শিবের সাথেও ধর্মের একটি সম্পর্ক বিদ্যমান। ওদিকে চর্যাপদ বৌদ্ধদের একটি ধর্মগ্রন্থ। সুফি ও বৈষ্ণব বলতেও এক শ্রেণীর ধর্ম সম্প্রদায়কেই বোঝায়। সকল ধর্মের  মূল হল সৃষ্টিকর্তা। কেননা ধর্মের আচরিক ক্রিয়াগুলো মূলত সৃষ্টিকর্তাকে ঘিরেই। আর এসবের মধ্য দিয়েই বাউলের উদ্ভব। তাই বাউল নৃত্যের সাথেও ধর্ম ও সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক বিদ্যমান। বাউলরা নৃত্যে মত্ত হয়ে সৃষ্টিকর্তার ধ্যানে  মগ্ন থাকে। গানের সুর তালে অবচেতন নৃত্যরত বাউলকেই বাউল নৃত্য বলে।

দুই :

বাউল নৃত্যে পোশাক পরিচছদঃ বাউলদের সাধারণ পরিহিত পোশাকই বাউল নৃত্যের পোশাক। বাউলদের গায়ে সাদা কিংবা গেরুয়া রঙের লম্বা পাঞ্জাবী বা আলখেল্লা থাকে। এছাড়া সাদা কিংবা গেরুয়া রঙ্গের লুঙ্গির মত এক- ধরনের পোশাক পরিধান পরে। কোমড়ে এক খন্ড কাপড় বাঁধা থাকে মাথায় কেউ কেউ পাগড়ী ব্যবহার করে, কেউ করে না। দক্ষিণ হস্তে একতারা এবং কোমরে অনেক সময় ছোট বাঁয়া বাঁধা থাকে। গলায় মোটা রুদ্রাক্ষ কিংবা কাঠের মালা থাকে। দুই তিনটা তজবীও গলায় থাকে, আনেকসময় তজবী হাতের কব্জিতেও বাঁধা থাকে। কারো কারো এক পায়ে ঘুঙুর বা নুপূর বাঁধা থাকে। কপালে আবার তিলক কাটতেও দেখা যায়।

তিন :

বাউল নৃত্যের চলনঃ  নৃত্য মূলত গানের সুর ও তালে দেহের অঙ্গ সঞ্চালন। বাউল নৃত্য প্রদর্শনে শাস্ত্রের ধরাবাধা নিয়ম নাই। বাউলরা গোল হয়ে বসে থাকে একজন গান গায় ও নৃত্য করে। কোন সময় একা বাউলকেও নৃত্যরত অবস্থায় দেখা যায়। মুদ্রা বলতে ডান হাত উপরে তুলে এবং বাম হাত কোমড়ে রেখে এক পা একবার সামনে নিয়ে যায় আবার পেছনে নিয়ে আসে। পায়ের স্টেপিং ও ডিপিং বাউল নৃত্যের প্রধান অঙ্গ সঞ্চালন। সাধারণত বাম পায়ের আঙ্গুলের উপর ভর করে ডান পায়ের চলন ঘটে। আবার দুই পায়ের ব্যবহার করতেও দেখা যায়। গানের স্থায়ী শেষ হলে অন্তরার মিউজিকের স্থলে উপর হয়ে ঘুরে ঘুরে নাচে। পেছনের পায়ে ঘুঙুর বাঁধা থাকে। ঘুঙুর বাঁধা পা মাটিতে মেরে নৃত্যের তাল রক্ষা করে। ডান হাতে একতারা আকাশমূখী উঁচানো থাকে এবং বাম হাত দিয়ে কোমরে বাঁধা বাঁয়ায় তালাঘাত করা হয়। বৈতালী গানগুলো দেহের নানা অঙ্গভঙ্গিমার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়।

চার :

বাউল নৃত্যে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র  বাউল নৃত্যে সাধারণত একতারা, বাঁয়া, ঘুঙুর, খঞ্জরি, কাঠ করতাল অনেক সময় দোতারার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। গানের সাথে এসব বাদ্যযন্ত্র সহযোগে বাউল নৃত্য পরিবেশন হয়।

ক) একতারাঃ  একতারা একতার বিশিষ্ট তত শ্রেণীর বাদ্যযন্ত্র বিশেষ। লাউয়ের খোল, চামড়া, বাঁশ, লোহার তার কিংবা পশুর তন্তু ইত্যাদি একতারা তৈরির মুখ্য উপাদান। হাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে তারে টোকা দিয়ে এ যন্ত্র বাজানো হয়। একতারা ছাড়া বাউল কল্পনাই করা যায় না ।একতারাই বাউলের মুখ্য পরিচয়।

খ) বাঁয়াঃ  বাঁয়া আনদ্ধ শ্রেনীর একটি বাদ্যযন্ত্র। মাটি, ষ্টীল, কাঁসা কিংবা পিতলের তৈরি ছোট খোল, চামড়া বাঁয়া তৈরির মূল উপাদান। বাঁয়াকে আঘাত করে গানকে তালের মধ্যে আবদ্ধ রাখা হয়। আর সেই তালে বাউল নৃত্য করে।

গ)  খঞ্জরি, ঘুঙুর, কাঠ করতালঃ খঞ্জরি আনদ্ধ শ্রেনীর বাদ্যযন্ত্র। বাউল নৃত্যের সময় গোল হয়ে বসে থাকা বাউলেরা গানের তালে এ যন্ত্র বাজিয়ে থাকেন । কাঠ করতাল কাঠের টুকরার মধ্যে ছিদ্র করে  লোহার চাকতী সংযুক্ত করে তৈরি করা হয়। দুই কাঠের তালাঘাতের মাধ্যমে যন্ত্রটি বাজানো হয়। ঘুঙুর সাধারণত পিতলের তৈরি। নৃত্যরত বাউলের পায়ে ঘুঙুর বাঁধা দেখা যায়।

পাঁচ :

বাউল নৃত্যের স্থান ও অন্যান্য প্রসঙ্গঃ  সুসজ্জিত মঞ্চ ছাড়া শাস্ত্রীয় নৃত্য প্রদর্শন হয় না। কিন্তু বাউল নৃত্য মাঠে, ঘাটে, আশ্রমে, গাছতলায় উন্মুক্ত স্থানে পরিবেশিত হয়। বর্তমানে কৃত্রিম বাউল সেজে আধুনিক মঞ্চেও বাউল নৃত্য উপস্থাপন হচেছ। বাউল নৃত্য মূলত একক নৃত্য। এ নৃত্যে সাধারণত পুরুষরাই অংশ গ্রহন করে থাকে। কোন কোন সময় বাউলের চরণদাসীদেরও নৃত্যে অংশ গ্রহন করতে দেখা যায়। বাউল সাধনার অন্যতম অঙ্গ হল নৃত্য।

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বাউল প্রেমে মজেছিলেন। তাই নিজেকে ‘রবীন্দ্র বাউল’ বলতে দ্বিধা করেননি। এছাড়া তাঁর ‘ফাল্গুনী’ ও ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে তিনি বাউলের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। অভিনয় করতে গিয়ে তিনি নিজেও বাউল নৃত্যে মোহিত হয়েছেন। বাউল সাধনায় ভান্ডের মধ্যে ব্রহ্মান্ডকে কল্পনা করা হয়েছে। তাঁদের কথায় ‘মানুষের ভিতরে  মানুষ করিতেছে বিরাজন ‘। এ প্রসঙ্গে বাউল নিত্যক্ষ্যাপা বলেন,

‘মানুষেতে মানুষ আছে

মানুষ নাচায় মানুষই নাচে  ।।’ ৩

সাধক ফিকির চাঁদ বাউল উপমার মাধ্যমে বলেন,

‘যিনি সেই চীন তাতারে রোম সহরে

বর্মা, কাষ্মীর ঝিল নেপালে

তিনি তোর ভাতের গ্রাসে খাটের পাশে

নাচিয়ে বেড়ান লয়ে কোলে।

যিনি তোর উপবীতে চাপদাড়ীতে

বেদ পুরান কোরান বাইবেলে

তিনি তোর খোল খমকে ঢোল ঢাকে

আলখেল্লায় ফুরফুরি ঝোলে।।’ ৪

মানুষের ভেতরের মানুষকে আপন দিলের চোখে দেখে হাসন রাজা বলেন,

‘হাসন রাজা দিলের চক্ষে আল্লাকে দেখিয়া

নাচে নাচে হাসন রাজা প্রেমে মাতাল হইয়া।।’৫

পরমাত্মার প্রেমে পাগল হয়ে সাধক জালাল উদ্দীন বলেন ,

‘মায়ার মোহে ছাড়াইয়া বন্ধন হারা হইলে

প্রেমের গন্ধে পাগল ছন্দে রসিক নাচে একতালে।।’৬

উপরিউক্ত সাধকদের দর্শন থেকে বোঝা যায় যে, নৃত্যের সাথে সৃষ্টিকর্তার যোগ বর্তমান। শুধুমাত্র নৃত্য প্রদর্শনের জন্য এঁরা নাচেন না। পৃথিবীর মায়া মোহ ত্যাজিয়া সাধক যখন সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভের জন্য ব্যকুল হয়ে গান করেন ,তখন বাঁধন হারা মন এমনিতেই নেচে উঠে। বাউলরা তেমনি সৃষ্টিকর্তার প্রেমে মোহিত হয়ে গানের ছন্দে আনন্দে নেচে উঠেন। সাধারণ ভাবে বাউলদের এই নাচই বাউল নৃত্য।

প্রয়াত সানাই শিল্পী ও সুর সাধক ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘সুর আমার আল্লা এবং সুরের সাধন হল আমার নামাজ৷’ সাধারণ অর্থে কথাটি উদ্ভট মনে হলেও নিগূঢ় অর্থে ভাবনাদায়ক। একই প্রসঙ্গে বলা যায়, বাউলদের সঙ্গীত সাধনাও তেমনি সৃষ্টিকর্তারই আরাধনা। গানের সুরে, বাদ্যের তালে ও নৃত্যের ছন্দে বাউল হারিয়ে যায় অসীম জগতে।

তথ্যপঞ্জিঃ

১। পল্লব সেন গুপ্ত , লোক সংস্কৃতির সীমানা ও স্বরূপ, সেপ্টেম্বর/০২ , পুস্তক বিপণি ,কলকাতা-৯,পৃষ্ঠা নং-২১৩

২। অতীন্দ্র মজুমদার- চর্যাপদ, ২০০১, নয়া প্রকাশ, কলকাতা- ০৬, পৃষ্ঠা নং- ১০৭

৩। সুধীর চক্রবর্তী (সম্পা:)  বাংলা দেহতত্ত্বের গান, জানুয়ারি/২০০০,পুস্তক বিপণি, কলকাতা-০৯, পৃষ্ঠা নং-১৫৩

৪। সুধীর চক্রবর্তী ,প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা নং- ১৮৬

৫। যতীন সরকার (সম্পা:) জালালগীতিকা সমগ্র- মার্চ/২০০৫, নন্দিত, ঢাকা-১০০০, পৃষ্ঠা নং -৩৪৪

৬। ড. আবুল আহসান চৌধুরী ,  প্রসঙ্গ হাসন রাজা, জানুয়ারি/১৯৯৮, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃষ্ঠা নং- ১৭৯

* প্রাবন্ধিক : ভাস্কর সরকার,

পিএইচ.ডি গবেষক,

ফোকলোর বিভাগ,

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ৷

x