ঢাকা, সোমবার ১০ মার্চ ২০২৫, ০২:২১ অপরাহ্ন
কিংবদন্তি কৃষক নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশ
ভাস্কর সরকার

প্রবীণরা হয়তো ভুলেই গেছেন, আর নবীনদের অধিকাংশ জানেনা বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশের দিনাজপুরে জন্ম নিয়েছিলেন কিংবদন্তি কৃষক নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশ। তার বাড়ি বা তার মাজার কোথায় তাও জানা নেই অনেকের। অপরদিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, দিনাজপুর গোর এ শহীদ বড় ময়দানে অবহেলা আর অযত্নে পড়ে আছে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশের মাজারটি। মাজার চত্বরে নেই কোনো সাইন বোর্ড কিংবা লিখিত নাম ফলক। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাবে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে মাজার চত্বরটি। রাজনৈতিক এই প্রাণ পুরুষের এক ছেলে তিন মেয়ের মধ্যে ছেলে ফারুক দানেশ ও দুই মেয়ে ইতোমধ্যে মারা গেছেন। জানা গেছে এক মেয়ে সুলতানা রেদওয়ানা রানু (৭২) এখন শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে দিনাতিপাত করছেন। দিনাজপুরের তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক গৌরব, পাক-ভারত উপমহাদেশের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা, ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তি প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা, ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হাজী মোঃ দানেশ। যে নামটি মেহনতি, মুক্তিকামি, শোষিত মানুষের অনুপ্রেরণার প্রতিক। সেই কিংবদন্তিতুল্য এই মানুষটি শুধু দিনাজপুর নয়, এই নেতা দিনাজপুরের গণ্ডি পেরিয়ে সারা দেশ তথা সারা উপমহাদেশে শোষিত ও নির্যাতিত মানব মুক্তির প্রতিক হিসেবে আবির্ভুত হন।

কৃষক নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশ ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে জুন ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির দিনাজপুর জেলার বোচাগঞ্জ থানার সুলতানপুর গ্রামে এক মুসলিম কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ গ্রামে শৈশবে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হলে সেতাবগঞ্জ থেকে প্রবেশিকা, রাজশাহী কলেজ থেকে আই.এ এবং বি.এ পাস করেন। পরবর্তীতে ভারতের উত্তর প্রদেশে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ এবং আইনে বি.এল ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর ঠাকুরগাঁও আদালতে প্রথম উকিল হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এছাড়া তিনি দিনাজপুর এস.এন কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতাও করেন। এক পর্যায়ে দিনাজপুর জেলা আদালতে আইন ব্যবসা আরম্ভ করেন। কৃষক, বর্গা চাষী, ভাগ চাষী, ক্রান্তি চাষীদের ওপর জমিদার ও জোতদারের সীমাহীন অত্যাচার দেখে হয়তো শিশু বয়সে মোহাম্মদ দানেশের মানসিক চিন্তায় বিপ্লব ঘটে। তিনি ছাত্র জীবনেই কৃষকের ওপর অত্যাচারের প্রতিকার কল্পে কৃষক আন্দোলনে আকৃষ্ট হন। হাজী দানেশ ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গসংগঠন কৃষক সমিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করেন। তার নেতৃত্বে দিনাজপুর জেলায় টোল আদায় বন্ধ ও জমিদারি উচ্ছেদের দাবিতে কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়। আন্দোলনকালে তিনি কারাভোগ করেন। নীলফামারি জেলার ডোমারে ১৯৪২ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় কৃষক সম্মেলনে অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন হাজী দানেশ। সম্মেলনের পরপরই তিনি গ্রেফতার হন এবং দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন। বর্গাচাষীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তিনি উত্তরবঙ্গে তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত করেন। তেভাগা আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্বে দাবি ছিল ১. উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দু’ভাগ চাই ২. জমিতে চাষীর দখল স্বত্ব দিতে হবে ৩. শতকরা সাড়ে বারো ভাগের বেশি অর্থাৎ মণকরা ধানের পাঁচ সেরের বেশি সুদ নেই  ৪. হরেক রকমের আবোয়ারসহ বাজে কোনো কর আদায় করা চলবে না ৫. রশিদ ছাড়া কোনো আদায় নেই ৬. আবাদযোগ্য সব পতিত জমি আবাদ করতে হবে ৭. জোতদারের পরিবর্তে ভাগচাষীদের খোলানে ধান তুলতে হবে। মূলত তারা ৩টি স্লোগান নিয়ে এগিয়ে এসেছিল (ক) নিজ খোলানে ধান তোল  (খ) আধা নয় তেভাগা চাই (গ) কর্জ ধানে সুদ নাই। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’।

হাজী দানেশ ১৯৪৫ সালে মুসলিম লীগে যোগ দেন। কিন্তু তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান অব্যাহত রাখার কারণে ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। ঐ বছরই তিনি বঙ্গীয় সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হন এবং ১৯৪৭ সালে মুক্তিলাভ করেন। এরপরই তিনি দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক পদে যোগ দেন৷ হাজী দানেশ ১৯৫২ সালে গণতন্ত্রী দল নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে গণতন্ত্রী দল যুক্তফ্রন্টে যোগ দেয়। যুক্তফ্রণ্ট মনোনীত প্রার্থী হিসেবে হাজী দানেশ ১৯৫৪ সালে দিনাজপুর থেকে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক ৯২-ক ধারা জারি করে পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেওয়ার পর তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৫৬ সালে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৫৭ সালে গণতন্ত্রী দল বিলোপ করে তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং দলের সহ সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারি হলে তিনি কারারুদ্ধ হন। হাজী দানেশ ১৯৬৪ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৫ সালে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা কর্মসূচির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। ১৯৭১ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। হাজী দানেশ মুজিবনগরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন।

হাজী দানেশ ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে (বাকশাল) যোগ দেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। বাকশাল সরকারের পতনের পর ১৯৭৬ সালে তিনি জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন পুনরুজ্জীবিত করেন। কিন্তু ১৯৮০ সালে এই দল বিলোপ করে হাজী দানেশ গণতান্ত্রিক পার্টি নামে একটি নতুন দল গঠন করেন এবং দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে গণতান্ত্রিক পার্টি জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে একীভূত করা হয়। হাজী দানেশ জাতীয় পার্টির অঙ্গ সংগঠন জাতীয় কৃষক পার্টির প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ১৯৮৬ সালে তিনি দিনাজপুর নির্বাচনী এলাকা থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। তবে হাজী মোহাম্মদ দানেশ তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবেই সমধিক পরিচিত।

মহান এই রাজনৈতিক নেতার নামে দিনাজপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও তাঁর গ্রামের বাড়ি বোচাগঞ্জ উপজেলার সুলতানপুর গ্রামে রয়েছে একটি কলেজ। এতটুকুতে সন্তুষ্ট নন তাঁর বর্তমান পরিবারের সদস্যরা ও দিনাজপুরের সর্বস্তরের মানুষ। এই জেলার মানুষের দাবি হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মহান এই নেতার মুরাল স্থাপন করার। এছাড়া এই মহান নেতার নামে প্রতিষ্ঠিত হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত দেশ বরেণ্য এই প্রাণ পুরুষের জন্ম কিংবা মৃত্যু বাষির্কী পালন ও স্মরণ করা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন এম.ফিল ও পিএইচ.ডি করছেন অনেকে কিন্তু যার নামে এ প্রতিষ্ঠান দুঃখের বিষয় তাঁকে নিয়ে কেউ কোনো আকর গবেষণা হয়নি এখনো। তরুণ প্রজন্মের উচিত এই মহান মানুষটির জীবন ও কর্ম নিয়ে উচ্চতর গবেষণার মাধ্যমে বাঙ্গালী যে লড়াকু জাতি সেটা প্রমাণ করা৷

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দলনে নেতৃত্বদানকারী যে ক’জন বরেণ্য ব্যক্তির নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে তাঁদের মধ্যে হাজী মোহাম্মদ দানেশ অন্যতম। ঠাকুরগাঁও  তথা বৃহত্তর দিনাজপুরের মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে আজীবন নিজেকে উৎসর্গ করা এই বিপ্লবী নেতা ১৯৮৬ সালের ২৮ জুন ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। সমাপ্তি ঘটে এক যুগান্তকারী প্রবাদ পুরুষের পার্থিব জগতের চলমান জীবন।

x