যে চীন থেকে এই প্রাণঘাতি করোনা ছড়াতে শুরু করেছে, সেই চীনের বর্তমান পরিস্থিতি কী? আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান দৌড়ে তারা বর্তমানে এতোটাই পিছে যে, করোনা যে চীন থেকে এসেছিল তা অনেকেই মনে করতে পারছে না! বরং করোনার ভয়াবহতা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট, ইটালি, ব্রাজিল আর বর্তমানে ভারতের নাম বিশ্বজুড়ে আলোচিত।
পরিসংখ্যান বিষয়ক সাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের সর্বশেষ তথ্যানুসারে, চীনে এপর্যন্ত করোনা আক্রান্ত ৯০,৫৯৯ জন আর মৃত্যুবরণ করেছে ৪৬৩৬ জন। যদিও চীনের প্রকৃত আক্রান্ত ও মৃত্যু নিয়ে অনেকের সংশয় আছে, তারপরেও বিশ্বস্বীকৃত এই পরিসংখ্যানকেই অফিশিয়াল সংখ্যা ধরতে হবে। পুরো বিশ্বের করোনা আক্রান্ত বিভিন্ন দেশের মধ্যে তাদের অবস্থান ৯৫তম, আর মৃত্যুতে ৫৮তম। যেখানে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ আক্রান্ত দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩তম, আর মৃত্যুতে ৩৭তম।
উপরের এসব তথ্য দেখে আগ্রহ হওয়া স্বাভাবিক, কীভাবে চীন করোনা মোকাবিলা করছে? কোন ভ্যাকসিন বা কোন পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করছে প্রাণঘাতি এই ভাইরাসকে?
চীন মূলত গতবছর জুলাই থেকেই সেদেশে ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু করেছে। চীনের ন্যাশনাল হেলথ কমিশন সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি সেন্টারের প্রধান ঝেং ঝংইউ’র ভাষ্যমতে (আগস্ট ২০২০), “স্বাস্থ্যকর্মী, সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ জরুরি ক্ষেত্রে কর্মরত লোকজনের অনেককেই কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। ইমার্জেন্সি ইউজের জন্য সেই ভ্যাকসিন জুলাই থেকে ব্যবহার করা হচ্ছে।” চীনে উৎপাদিত কয়েকটি ভ্যাকসিন জরুরিভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে সেদেশের সরকার। এর মধ্যে সাইনোভ্যাক ও সাইনোফার্মের দুটি টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। সর্বশেষ বিভিন্ন তথ্যমতে, চীনে এপর্যন্ত ২২ কোটির বেশি ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে, যার পুরোটাই তাদের নিজস্ব উৎপাদিত।
ভারতে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের নতুন চালান অনিশ্চয়তায় পড়ার মধ্যে চীনের একটি উদ্যোগে যুক্ত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
‘ইমার্জেন্সি ভ্যাকসিন স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি ফর কোভিড ফর সাউথ এশিয়া’নামক এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়ার সাড়া দেওয়ার কথা বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
চীন সরকারের বরাত দিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন,”চীন বলছে, আমাদের ভ্যাকসিন ডব্লিউএইচও কখন অনুমোদন দিবে আমরা জানি না। তবে এটা ১০০ মিলিয়নের বেশি লোক এটা ব্যবহার করেছে, ৮০টা দেশে আমরা রপ্তানি করেছি। ৬৩ দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এটা গ্রহণ করেছে। কারও কোনো অসুবিধা হয় নাই, এটাই একটা প্রমাণ। আবার যেসব দেশ টিকা নিয়ে গেছে, ডব্লিউএইচও তাতে কিছু মনে করেনি।” ওই উদ্যোগে বাংলাদেশের পাশাপাশি আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কাও সম্মতি দিয়েছে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন জানান।
এখন পর্যন্ত পুরো বিশ্বে এক বিলিয়নের বেশি মানুষ করোনার ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নিতে পেরেছে, সবচেয়ে বেশি ভ্যাকসিন নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ। এরপরেই রয়েছে চীন।
চায়না মিডিয়া গ্রুপের তথ্যানুসারে, বহু দেশে অনেক আগে থেকেই চীনা ভ্যাকসিন ব্যবহার শুরু হয়েছে। চীন যেমন ১৬০টিরও বেশি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে মহামারী-প্রতিরোধক সামগ্রী সরবরাহ করেছে, তেমনি এখন পর্যন্ত শতাধিক দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছে। পাকিস্তান, জিম্বাবুয়ে, মঙ্গোলিয়া, বেলারুসের মতো দেশগুলোতে যেমন চীনের ভ্যাকসিন-সহায়তা পৌঁছেছে, তেমনি সার্বিয়া, হাঙ্গেরি, পেরু, চিলি, মেক্সিকো, কলম্বিয়া, মরক্কো, সেনেগাল, ইউএই, তুরস্কের মতো দেশে ভ্যাকসিন রফতানিও করেছে ও করছে চীন। দৃশ্যত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এখন চীনা ভ্যাকসিনই একমাত্র ভরসা। এসব দেশের অনেক রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানও চীনা ভ্যাকসিন নিজেদের শরীরের গ্রহণ করেছেন। হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী, চিলির প্রেসিডেন্ট, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর নাম এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। ফাইজার, অ্যাস্ট্রেজেনেকা, জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা চীনা ভ্যাকসিনের চেয়ে বেশি বলে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এসব ভ্যাকসিন অত্যন্ত কম তামপাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। ফলে এগুলো পরিবহন করা কঠিন ও ব্যয়সাধ্য। অন্যদিকে চীনা ভ্যাকসিন সংরক্ষণের ঝামেলা কম, পরিবহনও সহজতর।
বাংলাদেশে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন কোভিশিল্ড কিনে তা প্রয়োগ শুরু করেছে। এই ভ্যাকসিনের তিন কোটি ডোজ কিনতে সেরাম বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে অগ্রীম অর্থ পরিশোধ করলেও ভারত অভ্যন্তরীণ চাহিদা আগে মেটানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় রপ্তানি আটকে গেছে। সেরাম থেকে দুই চালানে ৭০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া ভারত সরকারের উপহার হিসেবে এসেছে ৩২ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ পেয়েছে এক কোটি ২ লাখ ডোজ কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন। আর তা থেকে ৭২ লাখ ডোজ ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে। যারা প্রথম ডোজ পেয়েছেন, নতুন চালান না এলে তাদের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া অনিশ্চয়তায় পড়বে বলে নতুন উৎস থেকে ভ্যাকসিন পেতে সরকারের তৎপরতা শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ চীনা ভ্যাকসিন আনছে ঠিকই, কিন্তু তা এখনই প্রয়োগ শুরু করবে না বলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানানো হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন অথরিটির মতামত সাপেক্ষে সুবিধাজনক সময়ে তা প্রয়োগ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেমনটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করছে, তারা চীনা ভ্যাকসিন নিয়ে মজুত করে রেখেছে অনুমোদনের পরে ব্যবহার করবে বলে। তবে অনেক দেশ ব্যবহারও শুরু করেছে।
চীনের ২২ কোটি মানুষ ইতিমধ্যে যে ভ্যাকসিন ব্যবহার করেছে এবং তাতে তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খবর পাওয়াও যায়নি, এছাড়া সেদেশে করোনা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে অনেকটা ম্যাজিকের মতো। এটা দেখে ‘ভ্যাকসিন কূটনীতি’র মারপ্যাঁচকে দূরে ঠেলে চীনা ভ্যাকসিনের উপরে আশাবাদী হওয়া ছাড়া উপায় নেই, যতোক্ষণ না অক্সফোর্ড বা ফাইজারের মতো ভ্যাকসিন আবারও দেশের মানুষের জন্য সহজলভ্য হচ্ছে।
… [Trackback]
[…] Find More here on that Topic: doinikdak.com/news/9781 […]
… [Trackback]
[…] Find More to that Topic: doinikdak.com/news/9781 […]
… [Trackback]
[…] Info on that Topic: doinikdak.com/news/9781 […]