ঢাকা, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ০২:৪৯ পূর্বাহ্ন
একজন উপাচার্য নিয়োগের অপেক্ষায়
লেখক: প্রফেসর ড. মো. নাসিরউদ্দীন মিতুল. ডিন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
প্রফেসর ড. মো. নাসিরউদ্দীন মিতুল. ডিন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানডেমিক একাকী আসে না। এর সাথে সমান তালে ছড়িয়ে পড়ে ইনফোডেমিক ও ইকোডেমিক। কথাটি আবারো স্মরণে এলো। ফেইক ইনফরমেশন, মিস ইনফরমেশন, রং ইনফরমেশন এবং ডিস ইনফরমেশনের মধ্য দিয়েই কেটে গেলো ৯০ দিনের মত।

আর এভাবেই ভেস্তে যেতে বসছে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর লেখাপড়া, স্বপ্ন-সাধ, সবকিছু। আর ভাল্লাগে না। রোজ শুনছি স্বাক্ষর হয়ে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত সপ্তাহেই করে দিয়েছেন। ফাইল চলে গেছে মহামান্যের কাছে। এই প্রজ্ঞাপন হলো বলে। স্ক্রলের দিকে নজর রাখুন। যে কোনো সময় জেনে যাবেন কে হচ্ছেন আপনাদের উপাচার্য। কিন্তু একি? তিন মাস পার হতে চললো এ বিষয়ে কোনও সঠিক খবর এখনও আসেনি। এদিকে যত বিলম্ব বাড়ছে, তত বেশী গুঁজব, গুঞ্জন ডালপালা বিস্তার করেই চলছে।

কেউ বলছেন, মন্ত্রণালয়তো সেই কবেই তিন জনের নাম প্রস্তাব করে ব্লু-কাগজে প্রিন্ট করে পিএম দফতরে পাঠিয়ে দিয়েছে। সামান্য ধৈর্য ধরুন। কয়টা দিন স্ক্রলের দিকে তাকান। পেয়ে যাবেন। তাকিয়ে থাকতে থাকতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯ লক্ষ শিক্ষার্থী আর তাদের ২ কোটি ফ্যামেলী মেম্বারের চোখ যে ঝাপসা হয়ে এলো। ছানি পড়ে গেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অধিভুক্ত ২ হাজার ৩৭৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর চোখে।

ছানি অবশ্য আগেই পড়েছিল। করোনার কারণে যখন অন-লাইন ক্লাস চালু হয়েছিল, চোখে ছানি ঠিক তখন থেকেই পড়া শুরু করেছিল। কেনই বা পড়বে না বলুন? শিক্ষকতা জীবনে এমন চ্যালেঞ্জ যে আসবে তা কি কেউ আগে বুঝতে পেরেছিল? ল্যাপটপ, ডেস্কটপ আর স্মার্টফোনের সাহায্যে ক্লাস তৈরী করা কি চারটি খানি কথা?

ম্যানুয়াল সব প্যাডাগোজীকে একের পর এক স্লাইডে এনে কনটেন্ট তৈরী করা। অতঃপর জুমএ্যাপের মাধ্যমে সিডিউল করে দু’শোর অধিক শিক্ষার্থীকে আগাম লিঙ্ক পাঠিয়ে ক্লাস নেয়া। আমি তো দূরের কথা! আমার ফরটিন জেনারেশনের কেউ করেছে নাকি এমন কাজ! ফেস টু ফেস ক্লাসে যেখানে ৫০ মিনিটের মধ্যে ৩০ মিনিট বাক্য ব্যয় করে বাকি সময়টা শিক্ষার্থীদের সাথে ইন্টার-এ্যাকশনের মাধ্যমে কাটিয়ে দেয়া যেতো। তৈরী হতো দারুণ এক রসায়নের। সেখানে অন-লাইন ক্লাসে ক্রমাগত বকবক করা কি যা- তা ব্যাপার নাকি? মাথাতো অনেক আগেই শেষ। এবার চোখটাও গেল। এতকিছু সহ্য করে যে অন-লাইন ক্লাসগুলো নিচ্ছি তাদের চুড়ান্ত পরীক্ষাতো নিতে পারছি না। সবকিছু যেনো স্থবির হয়ে আছে। জাস্ট হার্ড ব্রেক কষে সময়টাকে যেন আটকে দেয়া হয়েছে। ঘড়ির কাঁটা চললেও লেখাপড়ার কাঁটা যেন এক্কেবারে স্থির হয়ে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।

বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় ছোটবেলার একটি মধুর স্মৃতি আমার মনে পড়ে গেলো। স্কুলে যাবার পথে দেখতাম মলমবিক্রেতা নানান কৌশলে মলম বিক্রি করছে। ব্যস্ত রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তার মলম বাজারজাতকরণের কৌশলগুলো আমায় দারুনভাবে আকৃষ্ট করতো। হাট বার এলেই মলমবিক্রেতার দেখা মিলতো।

গ্রাম্য হাটে প্রচুর লোক সমাগম হতো। ট্রলার, নৌকা, ডিঙ্গি, সাম্পান ও পায়ে হেঁটে লোকজন কেনাবেচা করতে সদর উপজেলার বাজারে আসতো। ভিড়ের মধ্যে চমৎকার সুরে যন্ত্রের তালে তালে মলমওয়ালা হাঁক দিতেন। আমার এখনো মনে আছে দরাজ গলায় তিনি বলতেন, ‘ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা একটা হাত তালি লাগাও’। উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা এসময় সহাস্যে হাততালি দিতো। আমি নিজেও সেই দলে থাকতাম। তবে সামনে বাচ্চাদের কাতারে। মলমবিক্রেতা বলেই চলতেন,… ‘বাবারা সোনারা আস্তে… আস্তে… আস্তে…।

জনাব জ্ঞানীসমাজ, গুণীসমাজ, সুধীসমাজ। জনাব বলবেন কিসের জন্য এই তালি? ভাবছেন এই তালি ঔষধ বিক্রির জন্য? মলমের জন্য? জ্বিনা জনাব। এই তালি কোন ঔষধ বা মলম বিক্রির জন্য নয়। এই তালি হচ্ছে আপনাকে সতর্ক করে দেয়ার জন্য। জ্বি হ্যাঁ জনাব, আপনার পিছনে কিছু দুই নম্বর ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন, যারা কথা কম বলেন, কাজ বেশী করেন। তাদের কাজ সবসময় দুই আঙ্গুলের। অতএব পকেট সাবধান।

আসুন জনাব, কথা কম বলে একটি সত্য ঘটনা বলি, একদিন রাতে আম্বিয়ার বাপে চীৎকার করিয়া কহিল, আম্বিয়ার মা, আম্বিয়ার মা, ধরছি-ধরছি। আম্বিয়ার মা’য় হ্যারিকেন বাতি জ্বালাইয়া কাছে গিয়া দেখে আম্বিয়ার বাপে কিছুই ধরতে পারে নাই। জ্বি হ্যাঁ জনাব, গুঁড়া কৃমি ধরা যায় না। গুঁড়া কৃমি মারতে হয়। বলবেন, কিভাবে? চলে আসুন আমার কাছে। আর জনাব, এই যে আরেকটি ঔষধ দেখছেন? এটি বিশ্বে ইন্দুর মারার একমাত্র ঔষধ। এটি শুধু ইন্দুর চলাচলের পথে সামান্য ছিটিয়ে রাখবেন। যদি ইন্দুর জায়গায় হার্ড ব্রেক না কষে তবে কসম খোদার, উপরে আল্লাহ নীচে মাটি, আমার গাল আপনার চটি’। সেই আশির দশকের স্মৃতিকথা এগুলো। অথচ এখনও প্রাসঙ্গিক।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে কেন জানি আমার সেই মলমওয়ালার কথাগুলো সত্যি মনে পড়ছে। আমরা কি তবে সেই একই জায়গায় ব্রেক কষে আছি? সামনে পিছনে কোথাও নড়তে পারছি না। শিক্ষা-কার্যক্রমের পথে পথে তবে কি সেই ইঁদুর মারার ঔষধ ছিটানো হয়েছে? এর জন্য শুধু কি করোনা দায়ী?

সংশ্লিষ্টদের কি কোনো দ্বায়ভার নেই? আরে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজকর্ম চালাতে তো এত দীর্ঘসূত্রিতার কথা নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স এখন ২৯ বছর। এর নিজস্ব ক্যাম্পাসে শিক্ষক সংখ্যা শতাধিক। এখানে ৫০ ঊর্ধ্ব অনেক সিনিয়র প্রফেসর রয়েছেন, যারা অনেক বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সক্ষমতা রাখেন। তাছাড়া কত জ্ঞানীগুণী জন, কত মহাজনতো ডাটাবেজে রয়েছেনই। দিন না এ্যাসাইন করে তাদের মধ্য থেকে সৎ, মেধাবী দক্ষ ও একাডমিক কাজে বলিষ্ঠ এমন কাউকে।

তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৪৬টি। অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১০৭টি। এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে বর্তমানে দেশের ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই। আর সহ-উপাচার্য নেই ১০৭টিতে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে চারটিতে এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭টিতে এখন উপাচার্যের পদ শূন্য।

দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য নিয়োগ পদ পুরনে এই মুহূর্তে ৩২১ জন যোগ্য ও পছন্দনীয় অধ্যাপক লাগবে যা পাওয়া সত্যি নাকি বেশ কষ্টসাধ্য। মতামতটি ইউজিসি’র এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার। উপাচার্য, সহ-উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে তাই Samuel Taylor Coleridge এর সেই বিখ্যাত Rhyme, The Ancient Mariner এর কথা মনে পড়ছে। ‘Water Water Everywhere but not a single drop to drink’. Rhyme টি অবশ্য আমাদের ব্যাচেলর জীবনে মজা করে ব্যবহৃত হতো একটু মোডিফাই আকারে- ‘girl girl everywhere but not a single girl for marry’. নারীদের মুখেও এ বাক্যটির মোডিফাইড ভার্সন অনেকবার শুনেছি। ভাবছি কেউ যদি এর সাথে মিল রেখে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে বলে ফেলে ‘Professor Professor everywhere but not a single professor for assigning as VC and Pro VC. নেহায়েত অপ্রাসঙ্গিক হবে কি?

যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে চলতি দায়িত্ব দিয়ে রুটিন কাজ করানো হচ্ছে তা আসলে কোনো কাজেই আসছে না। একেতো করোনা। তার ওপর আবার উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, ট্রেজারার কেউ নেই। তাই নেয়া যাচ্ছে না কোনো সিদ্ধান্ত। কোর্স ফাইনাল পরীক্ষা, ভর্তি পরীক্ষা, সনদ বিতরণ, সাক্ষাৎকার গ্রহণ, জরুরী পরিসেবা কিছুই করা যাচ্ছে না। শিক্ষা-কার্যক্রম না হয় বন্ধ। কিন্তু প্রশাসনিক কার্যক্রমতো আর বন্ধ রাখার সুযোগ নেই। রুটিন দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তাব্যক্তিবর্গকে যে ক্ষমতা দেয়া আছে সেখানে নতুন করে করার কিছু থাকে না। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে সব সময় নতুন কিছু করার প্রচেষ্টা থাকে।

এমনকি সিলেবাসটি পর্যন্ত প্রতি বছর সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন করতে হয়। তাছাড়া রুটিন দায়িত্বে নিয়োজিত উপাচার্যগন নিয়োগ, পদন্নোতিসহ পরবর্তী কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন না। তাই সবকিছু আটকে আছে। ক্রমান্বয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। মোদ্দা কথা, উপাচার্য না থাকলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না। শৃঙ্খলাও থাকে না। যেহেতু ১৫ মাস ধরে অন-লাইন ক্লাসে যুক্ত থেকে মাথা খেয়েছি। ৯০ দিন ধরে টিভি স্ক্রলে তাকিয়ে থেকে চোখেরও বারোটা বাজিয়েছি। তাই অনুরোধ করছি শিক্ষা- প্রতিষ্ঠান খুলে দিন। দয়া করে উপাচার্য ও সহ- উপাচার্য পদে এমন কাউকে দিন যেন তা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদের প্রতিও সম্মানজনক হয়।

ইদানিংকালে বেশ কিছু উপাচার্যদের দুর্নীতির চিত্র আমাদের জানা। সত্য-মিথ্যা তদন্তাধীন। এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে বিশ্বাস করি, উপাচার্য হিসেবে সম্মান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক উৎকর্ষর চেয়ে নিজের আর্থিক লাভবানের বিষয়টি কেউ যদি বড় করে দেখে, তা জাতি গঠনে সহায়কতো নয়ই বরং জাতি ধ্বংসের সহায়ক হবে। উপাচার্যগন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক ও প্রশাসনিক আইকন। সংশ্লিষ্টদের কাছে বিশেষ অনুরোধ, জেনে শুনে যোগ্য, সৎ ও উত্তম গুনাবলীর প্রকৃত পেশাদার ব্যক্তিদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিন। সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো এ কাজে অধিক তৎপর হয়ে কম সময়ে প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশাসী স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রফেসরদের একটি ডাটাবেজ চুড়ান্ত করে সেখান থেকে নিয়োগ দিলে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এ কাজটি সহজ হবে বলেই আমি মনে করি।

লেখক: প্রফেসর ড. মো. নাসিরউদ্দীন মিতুল. ডিন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

One response to “একজন উপাচার্য নিয়োগের অপেক্ষায়”

  1. … [Trackback]

    […] Find More on that Topic: doinikdak.com/news/21086 […]

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x