ঢাকা, শুক্রবার ০৭ মার্চ ২০২৫, ০১:১৩ পূর্বাহ্ন
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম সামরিক ব্রিগেড ‘জেড ফোর্স’
ভাস্কর সরকার
দৈনিক ডাকঃ শুধু গেরিলা যুদ্ধ করে কোনাে বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশ বাহিনীও শুধু গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে অস্ত্রসমর্পণ করতে বাধ্য করবে, সে দুরাশা কখনাে করেনি। গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল এজন্যে যে প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ বাহিনীর জনবল ও অস্ত্রবল ছিল একেবারেই অপ্রতুল। তাছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ করার ফলে বহু অস্ত্রশস্ত্র নষ্ট হয়ে যায়। তাই পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়ার সামর্থ না হওয়া পর্যন্ত গেরিলা যুদ্ধ করে শক্রর জনবল, মনােবল ও অস্ত্রবল নষ্ট করে তার সম্মুখ সমরের শক্তিকে পর্যুদস্ত করে তারপর তাকে সরাসরি আঘাত হানতে হবে। এই কৌশলকে সামনে রেখেই গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি বিগ্রেড ফোর্স গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
৭ জুলাই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম ব্রিগেড গঠন করা হয়। যদিও বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী প্রধান এমএজি ওসমানী ১৩ই জুন ১৯৭১ মেজর মঈনুল হোসেনকে বিগ্রেড গঠনের সিদ্ধান্ত অবহিত করেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার গেজেটের জন্য, ফোর্সটি ৭ জুলাই ১৯৭১ গঠিত হিসাবে পরিচিত হয়। ব্রিগেডটি বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার এর অনুমোদন সাপেক্ষে গঠিত হয়। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩টি ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে গঠন করা হয় এই ব্রিগেড। ব্রিগেডের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মেজর জিয়াউর রহমান এবং তার নামের আদি অক্ষর নিয়েই ব্রিগেডের নামকরণ করা হয় ‘জেড ফোর্স’। ব্রিগেডের অঙ্গ তিনটি ব্যাটেলিয়ন হলাে- ১ম ইস্ট বেঙ্গল, ৩য় ইস্ট বেঙ্গল ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটেলিয়ন। এটাই ছিল তৎকালীন স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রথম একটি সম্পূর্ণ ব্রিগেড। এটি তুরা ব্রিগেড নামেও পরিচিতি আছে। কেননা এই বিগ্রেডটি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পশ্চিম গারো পাহাড় জেলার তুরা নামক স্থানে সদর দপ্তর গঠিত হয়েছিলো৷
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ম ব্যাটালিয়ন যশোর সেনানিবাস হতে সেনাসদস্যরা মেজর হাফিজ এর নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে প্রচন্ড লড়াইয়ের পর মেজর হাফিজসহ মাত্র ৫০ জন জোয়ান ও অফিসার সীমান্ত অতিক্রমে সক্ষম হন। এছাড়া ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর ৩য় ব্যাটালিয়নও যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছিল। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর ৮ম ব্যাটালিয়ন ছিল সম্পূর্ণ নতুন ও সীমিত শক্তির।
ব্রিগেড এর কাঠামো  ছিলো: বিগ্রেড কমান্ডার – মেজর জিয়াউর রহমান, ব্রিগেড মেজর – ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ, ডি-কিউ কর্মকর্তা – ক্যাপ্টেন সাদেক, সংকেত কর্মকর্তা – ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম, ব্রিগেড মেডিকেল অফিসার – আব্দুল হাই মিয়া৷ এছাড়া মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরীকে দেওয়া হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ম ব্যাটালিয়ন এর দায়িত্ব ও উপযুক্ত ব্যাটালিয়নে রূপ দেবার। মেজর শাফায়াত জামিলকে দেওয়া হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩য় ব্যাটালিয়ন এর দায়িত্ব ও সংগবদ্ধ করার। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৮ম ব্যাটালিয়ন এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এ জে এম আমিনুল হক। মাত্র ছয় সপ্তাহের প্রশিক্ষণ শেষে রূপ নেয় জেড ফোর্স যা ছিল বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর অন্যতম নির্ভীক এক ব্রিগেড।
জেড ফোর্সের অপারেশনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কামালপুর যুদ্ধ৷ পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে এবং জামালপুর হয়ে ময়মনসিংহ সড়ক সংযোগে কামালপুর ছিল পাক বাহিনীর অন্যতম শক্ত সীমান্ত ফাঁড়ি। সেখানে ছিল গোলা-নিরোধী ছাদ বিশিষ্ট কংক্রিট বাংকার/পরিখা যেগুলি প্রতিটি গভীর নালার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও সাহায্য বিনিময়ে সক্ষম, নিরাপত্তার বেষ্টনী হিসাবে ছিল স্ব-নিয়ন্ত্রিত ফাঁদ ও ভূমিবিস্ফোরক এবং অন্ধকারের সময় পাকিস্তানের সৈন্যরা একেবারে ভিতরের নিরাপদ স্তরে ঢুকে যেত। ১৯৭১ সালের ৩১শে জুলাই দিবাগত রাত্রে (১লা অগাস্ট রাত) জিয়াউর রহমান এর নির্দেশ মোতাবেক মেজর মইনুল হোসেন এর নেতৃত্বে উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে ডেল্টা এবং ব্রাভো শত্রুপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই আক্রমণ থেকে প্রত্যক্ষভাবে জয় না পেলেও এই আক্রমণে ২০০ এর অধিক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং তাদের মনোবলের উপর ছিল বড় ধরনের ধাক্কা একই সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে ছিল উৎসাহের প্রতীক। এটি এতই শক্তিশালী ঘাঁটি, যে এই ঘাঁটিতে এরপর সর্বমোট ৪ বার নিয়মিত বাহিনী পর্যায়ে সরাসরি সেটপিস যুদ্ধ হয়েছে৷ বীর উত্তম থেকে বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ২৯ জন মুক্তিযোদ্ধা সাহসিকতা পদক পেয়েছেন কেবল কামালপুর যুদ্ধের জন্যই, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এমন উদাহরণ আর একটিও নেই।
জেড ফোর্সের আরেকটি সাহসী আক্রমণ হলো নকশী সীমান্তের যুদ্ধ৷ শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী থানার নকশি সীমান্ত ফাঁড়ি ছিল পাকিস্তানের একটি শক্ত ঘাঁটি। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে এটি জেড ফোর্স এর আক্রমণ তালিকায় নেওয়া হয়। আক্রমণে ছিল ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদের আলফা কোম্পানি আর লেঃ মোদাসেরের ডেল্টা কোম্পানি। সুবেদার হাকিমের ইপিআর কোম্পানিটি ছিল কাট অফ পার্টি হিসেবে। ফায়ারিং কভার দেয়ার দায়িত্বে ছিলেন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার মেজর আমিনুল হক। আর ফাঁড়ির পাশে শালবনে ফরোওয়ার্ড এরিয়া অ্যাসেম্বলী থেকে জিয়া ওয়ারলেস যোগাযোগের মাধ্যমে যুদ্ধ কোঅর্ডিনেট করেছিলেন। এই যুদ্ধে জয়ী হলেও পাক বাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে ক্যাপ্টেন আমিন আহত হলে ব্রাভো কোম্পানি মনোবল হারায়। মোট ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা সে যুদ্ধে শহীদ হন।
ঘাসিপুরের যুদ্ধও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের এক অনন্য দলিল৷ ১০ই সেপ্টেম্বর, ঘাসিপুরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর ১ম ব্যাটিলিয়ন ডেল্টা ফোর্স শক্ত অবস্থানে আসে যা ছিল কমলপুর সীমান্ত ফাঁড়ির খুবই নিকটবর্তী একটি সংবেদনশীল অবস্থান। খাদ্য, যোগাযোগ ও অন্যান্য বিভিন্ন সুবিধার জন্যে ঘাসিপুর ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সেজন্যে জেড ফোর্স এর ঘাসিপুরের শক্ত অবস্থান কামালপুর ঘাঁটির জন্যে দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল। কামালপুর ঘাঁটি সুরক্ষিত রাখার জন্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর তথা জেড ফোর্স এর প্রতিরক্ষার উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। অসামান্য দৃঢ়তার ও সাহসিকতার মুখে পাকিস্তানের এ আক্রমণ সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয় এবং যথেষ্ট ক্ষতি স্বীকার করে নিয়ে তারা পিছু হতে যায়। এ যুদ্ধে রেজিমেন্ট এর ল্যান্স নায়েক ইউসুফ এবং সুবেদার মোজাম্মেল শহিদ হন।
এছাড়াও বাহাদুরাবাদ যুদ্ধ, দেওয়ানগঞ্জ থানা আক্রমণ, চিলমারী উভচর অভিযান, হাজীপাড়া, ছোটখাল, গোয়াইনঘাট,টেংরাটিলা, গোবিন্দগঞ্জ, সালুটিকর বিমানবন্দর, ধলাই চা-বাগান, ধামাই চা-বাগান, জকিগঞ্জ, আলি-ময়দান, এমসি কলেজ, ভানুগাছ, কানাইঘাট, বয়মপুর, ফুলতলা চা-বাগান, সাগরনালা চা-বাগান, লাতু, বড়লেখা প্রভৃতি যুদ্ধ জেড ফোর্সের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভের পর জেড ফোর্স ভেঙ্গে দেয়া হয়৷
মূলত স্বাধীনতা একটি শর্ত, যেখানে একটি জাতি, দেশ বা রাষ্ট্র বা জায়গা যেখানে জনগণ থাকবে, নিজস্ব শাসনব্যবস্থা, গণতন্ত্র এবং সাধারণত কোন অঞ্চলের ভৌগলিক সার্বভৌমত্ব থাকবে। তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের প্রেক্ষাপট ছিলো বঙ্গবন্ধুর জ্বালাময়ী ভাষণ, কৃষক-শ্রমিক-মজুর থেকে শুরু করে স্বাধীনতাকামি সকল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের রক্তিম ইতিহাস৷ তাই স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা করা নয়, এর তাৎপর্য অনেক নিগূঢ়৷
লেখকঃ
পিএইচ.ডি গবেষক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়৷
x