ঢাকা, শুক্রবার ১১ অক্টোবর ২০২৪, ১১:০৪ অপরাহ্ন
৫০ বছরেও মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা পাননি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ
Reporter Name

আবুল কাশেম রুমন,সিলেট: প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ-এর গৌরবময় স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত হলো এই মাত্র ক’দিন পূর্বে। এক সাগর তাজা রক্ত, অগণিত মা-বোনের ইজ্জত হারিয়ে আর লক্ষ-লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মহান স্বাধীনতার ৫০ বছর ইতিমধ্যে অতিক্রান্ত হলেও একাত্তরের রনাঙ্গনের সাহসী যোদ্ধা মো. আব্দুর রশীদ তাঁর ন্যায্য পাওনা রাষ্ট্র প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা আজও পাননি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও  নিঃস্ব-অসহায় আব্দুর রশীদ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্বারে-দ্বারে বছরের পর বছর ধর্ণা দিতে দিতে এখন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত এবং দিশেহারা। মাঝে-মাঝে নীরবে চোখের জলও ঝরান তিনি।

দুস্থ-অসহায় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশীদ-এর আদি নিবাস হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলাধীন কাসিমপুর গ্রামে। ১৯৫০ সালের ১লা জুন তাঁর জন্ম। পিতা মরহুম আব্দুল মনাফ ওরপে মন্নাফ এবং মাতা- মরহুমা বারি বেগম।

একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে আব্দুর রশীদ টগবগে যুবক। তাঁর অবস্থাও ছিলো মোটামুটি স্বচ্ছল। সিলেট শহরের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আব্দুর রশীদ তখন বাবুর্চির হেলপার হিসেবে ছিলেন কমর্রত। পুলিশ ফাঁড়ির সম্মুখে  তাঁর পান-সিগারেটের একটি দোকানও ছিলো। কর্মচারী দিয়ে এ দোকান পরিচালনা করতেন তিনি। এছাড়াও ছিলো ৪ খানা রিক্সা। এসব থেকে সংসার চালানোর মতো আয়-রোজগার হতো। এক সময় আব্দুর রশিদ রাজধানী ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বাবুর্চির হেলপার ছিলেন। সেখানে তাঁর মুল দায়িত্ব ছিলো পুলিশ সদস্যদের ডাইনিং হলে খাবার পরিবেশন করা।

একাত্তরের ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২ টা ১০ মিনিটে সিলেটে আক্রমণ করে পাক হানাদার বাহিনী। বর্বর পাক বাহিনী শহরে সর্ব প্রথম হামলা করে সিলেট পুলিশ সুপারের কার্যালয়, পার্শ্ববর্তী বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়ি, কতোয়ালী থানা, সিলেট পুলিশ লাইন্স, আখালিয়াস্থ বিডিআর সেক্টর হেড কোয়ার্টারসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায়। ২৫ মার্চের এ কালো রাতের অপারেশনে পাক সেনারা অতর্কিত হামলার মাধ্যমে নিরীহ-নিরপরাধ লোকদের বর্বর নির্যাতনের পাশাপাশি অনেককে হত্যাও করে।

দখলদার পাক সেনারা রাতের বেলা বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়ির পানির হাউসে প্র¯্রাব করলে আব্দুর রশীদ এর প্রতিবাদ করে বলেছিলেন,  ‘এ হাউসের পানি আমরা পান করি,  আর আপনারা এখানে প্র¯্রাব করলেন ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দুতে এ কথাগুলো উচ্চারণের সাথে সাথে  তাঁকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে বেদম প্রহার শুরু করে পাক জানোয়াররা। হানাদারদের অবর্ণনীয় নির্যাতনে আব্দুর রশীদের মেরুদন্ড ও ডান পা ভেঙে যায়। মাথা এবং শরীরের নানা অংশে  মারাত্মক জখম হয়। পরে পুলিশ ফাঁড়ির দখলদার পাক বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজরের হস্তক্ষেপে আব্দুর রশীদ সে রাতে প্রাণে রক্ষা পান।

পাক সেনাদের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে কিছু দিন পরেই আব্দুর রশীদ সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়ি থেকে পালিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা চলে যান। আগরতলাস্থ পালাটা ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে মেজর শফিউল্রাহ (পরবর্তীতে লেঃ জেনারেল ও সেনা প্রধান)-এর অধীনস্থ এস ফোর্স -এর অধীনস্থ কোম্পানি কমান্ডার শফিকুল আলম আরজু মাস্টারের কমান্ডে এবং গ্রæপ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম চৌধুরীর অধীনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগর এলাকায়  মুক্তিবাহিনীর অপারেশনে অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশীদ।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলে আব্দুর রশীদ তাঁর ব্যবহৃত থ্রি নট থ্রি রাইফেলটি হবিগঞ্জের পোদ্দার বাড়িতে স্থাপিত অস্ত্র গ্রহণ ক্যাম্পে তদানীন্তন মেজর (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল) এজাজ আহমেদ চৌধুরীর কাছে জমা দেন এবং মুক্তিযোদ্ধা সনদ গ্রহণ করেন।
মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আব্দুর রশীদ অক্ষর জ্ঞানহীন। তাই মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্রসহ অন্যান্য কাগজপত্র সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে ফেললে পরবর্তীতে অনেক চেষ্টা করে তাহা উদ্ধার করতে সক্ষম হন।

মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকা(পদ্মা)য়  তাঁর নাম- ঠিকানা সংরক্ষিত রয়েছে। যার বহি নং পি-৫৯, ক্রমিক নং-১৯০, নামঃ আব্দুর রশিদ, পিতা-আব্দুল মনাফ, থানা ও উপজেলা-মাধবপুর, জেলা-হবিগঞ্জ। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর যোদ্ধা আব্দুর রশিদ জীবনযুদ্ধে আজ পরাজিত। স্ত্রীকে হারিয়ছেন অনেক আগেই। একমাত্র পূত্র নূরুল ইসলামও শারীরিক প্রতিবন্ধী।  প্রতিবন্ধী পুত্র, পুত্রবধূ এবং নাতি-নাতনীদের নিয়ে সত্তরউর্ধ্ব আবদুর রশীদ জীবন যুদ্ধে একেবারে দিশেহারা। বেচেঁ থাকার তাগিদে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশীদ সামান্য মাইনে এখন সিলেট নগরীর শিবগঞ্জ বাজারস্থ আকবরী জামে মসজিদের ঝাড়ুদার হিসেবে কমর্রত।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ সম্মানী ভাতা লাভের জন্য দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর কতো স্থানে, কতো জনে ধর্ণা দিয়েছেন-এর কোনো ইয়ত্তা নেই। তার বক্তব্যে ফুটে উঠেছে, অবশেষে অনেক কষ্টে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন।

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বাঁচার সামান্য অবলম্বন হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতার জন্য দ্বারে দ্বারে ধর্ণা দিতে দিতে বয়োবৃদ্ধ আব্দুর রশীদ  যেমনি নিঃস্ব-রিক্ত হয়েছেন, তেমনি মোটা অংকের টাকা ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েছেন ইতিমধ্যে।
বৃদ্ধ বয়সে অনেক পরিশ্রম, অর্থ ব্যয়, দৌড়-ঝাপ এবং কাঠখড় পোড়ানোর পর কাগজপত্র সংগ্রহ করে ২০১৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা লাভের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবরে যথারীতি আবেদন করেছেন। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা প্রদান সংক্রান্ত মাধবপুর উপজেলা কমিটির সভায় তাঁর কাগজপত্র সঠিক বিবেচিত হওয়ায়  আব্দুর রশিদসহ ৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মানী ভাতা প্রদানের নিমিত্তে অর্থ বরাদ্দের আবেদন জানিয়ে মাধবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের আবেদন জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, মাধবপুর, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে অফিসিয়ালি চিঠি প্রেরণ করেন গত ১৯/০১/২০২১ঃইং তারিখে। উল্লেখিত ৫’জন মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতার প্রয়োজনীয় অর্থ এপর্যন্ত হবিগঞ্জ এসে পৌঁছেনি।

3 responses to “৫০ বছরেও মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা পাননি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ”

  1. sex women says:

    … [Trackback]

    […] Here you will find 51166 more Info to that Topic: doinikdak.com/news/9663 […]

  2. … [Trackback]

    […] Read More to that Topic: doinikdak.com/news/9663 […]

  3. … [Trackback]

    […] Read More here to that Topic: doinikdak.com/news/9663 […]

Leave a Reply

Your email address will not be published.