ঢাকা, শনিবার ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:২০ পূর্বাহ্ন
করোনায় মৃতদের লাশ দাফনে বিড়ম্ভনায় সেচ্ছাসেবী টিম 
জয়নাল আবেদীন রিটন, ভৈরব প্রতিনিধি

করোনাকালে কোভিডে আক্রান্ত মৃত লাশের দাফন কাফনের জন্য যখন কোন লোক পাওয়া যাচ্ছিলনা তখন ভৈরব সেচ্ছাসেবী নামে একটি টিম এগিয়ে আসে লাশের দাফন কাফন করতে। লাশ দাফন করতে গিয়ে সেচ্ছা সেবী টিমকে পড়তে হয় নানা বিড়ম্ভনায়। সংক্রমিত হওয়ার ভয় ও শংকায় পরিবারের সদস্যরা লাশের ধারে কাছেও কেউ আসতে চায়না। লাশ দাফনে    প্রয়োজনিয় উপকরণগুলোও দিতে চায়না পরিবারের লোকজন। নানাবিধ সমস্যা নিয়েই লাশ দাফন কাফন করছেন সেচ্ছাসেবী টিমের লোকজন। যথা নিয়মে স্বাস্থ্যবিধি মেনে লাশ দাফন করায় এ পর্যন্ত আক্রান্তও হয়নি এ টিমের কোন সদস্য।

জানা যায়, ভৈরবে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৪২ জন। করোনাকালের শুরুতে ভৈরবের জগন্নাথপুর গামে বিদেশ ফেরৎ এক ব্যাক্তি কোভিড আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তখন লাশের দাফন করতে লোক না পাওয়ায় ঢাকা থেকে লোক এসে দাফন কাজ শেষ করেন। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের নির্দেশনায় ৩০ জন সদস্য নিয়ে একটি টিম গঠন করা হয়। এদের মধ্যে নারী রয়েছে ৫ জন। এর বাহিরেও অনেকেই আছেন যারা নিজেদের পরিচয় গোপন রেখেই কাজ করছেন। টিম গঠনের পর থেকে তারা এ পর্যন্ত ৩৬ জনের মৃত দেহ গোসল করানো থেকে দাফন কাফন করেছেন যথানিয়মে স্বাস্থ্য বিধি মেনে। তবে লাশ দাফন করতে গিয়ে তাদের অনেক সময় পড়তে হয়েছে বিপাকে। লাশ দাফণ করার সময় পরিবারের কাউকে কাছে পাওয়া যানি। লাশ দাফনে প্রয়োজনিয় উপকরণ গুলোও তারা দিতে চায়না সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে। খাটিয়ায় ধরবে এমন লোকও পাওয়া যায়না। এক সময় যে লোকটি পরিবারের ভরণ পোষন করতে গিয়ে নিজের আরাম আয়েশ বাদ দিয়ে দিনে রাতে পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করেছেন পিতা মতা ভাই বোন আর স্ত্রী সন্তানদের জন্য, আজ মারা যাবার পর তারা কেউ এক নজর দেখতেও চায়না, লাশ দাফন করতে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন সেচ্ছাসবী টিমের সদস্যর্।া অপরদিকে লাশ দাফন করে ফেরার পথে পরিবহনে নিতে চায়না এ সেচ্ছাসেবী টিমের লোকদের কোভিড আক্রান্ত লাশ দাফন করায়। তারপরও তারা দুখ কষ্ট আর বিড়ম্বনা নিয়ে খবর পাওয়া মাত্রই দিনে রাতে লাশ দাফনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। মানুষের উৎসাহ উদ্দিপনায় উৎসাহিত হয়ে শুধু লাশ দাফণই নয়, দেশে যে কোন দুর্যোগ পরিস্থিতিতে এ সেচ্ছাসেবী টিম সর্বদা কাজ করে যাবে এটাই তাদের উদ্দ্যেশ্য।

টিম লিডার,হাফেজ মাওলানা আনাছ মাহমুদ বলেন,একটা সময় যখন আসল কোভিডে আক্রান্ত মৃতের লাশ দাফন কাফনের জন্য কোন লোক পাওয়া যাচ্ছিলনা। তখন আমাদের টিমের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নিলাম একাজগুলো আমরা করব। আমরা উৎসাহিত হয়ে ইউএনও মহোদয় কাছে প্রস্তাব করলে তিনি আমাদেরকে সাপোর্ট করেন। পরবর্তী সময়ে আমাদের টিমের সদস্যরা ৩৬ জনের লাশ দাফন করেছি। লাশ দাফনের পর আমাদের ব্যবহৃত স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীগুলো কেরোসিন দিয়ে ঐ খানেই পুড়িয়ে ফেলি। যথা নিয়মে স্বাস্থ্যবিধি পালন করলে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা। পাশাপাশি আমরা এ পর্যন্ত ২৬ জনকে ফ্রি অক্সিজেন সেবাও দিয়েছি। এছাড়াও করোনাকালে অনেক পরিবার আছে কষ্ট করবে কিন্তু কারো কাছে চাইতে পারেনা এ ধরনের লোকদের খোজে বের করে আমাদের সেচ্ছাসেবী টিমের মাধ্যমে নগদ অর্থ ও খাদ্য সামগ্রী পৌছে দিয়েছি। দেশে যে কোন দুর্যোগ পরিস্থিতিতে আমাদের এ সেচ্ছাসেবী টিম সর্বদা কাজ করে যাবে।

টিম সদস্য সাইফুল ইসলাম সাহেল বলেন, যখন জানতে পারি করেনায় মৃত ব্যক্তির লাশ পড়ে আছে তখন আমরা লাশের গোসল থেকে শুরু করে দাফনের কাজ শুরু করি। এ কাজগুলো করতে গিয়ে অনেকেই আমাদের সাথে টিমে নাম লিখিয়ে ছিল। পরিবারের বাধার কারণে অনেকেই সরে গেছেন। আবার অনেকেই আছে এখনো পর্যন্ত তাদের পরিচয় গোপন রেখে কাজ করছেন। লাশ দাফন করতে গিয়ে অনেক অমানবিক অভিজ্ঞতা অর্জন হয়েছে। পরিবারের অতি আপন ব্যাক্তিটি আজ লাশ হয়ে পড়ে আছে অথচ আজ সে অনেক পড় হয়ে গেছে। তাকে দেখা বা ধরার প্রয়োজন মনে করেনি কেউ।

করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বহিী কর্মকর্তা লুবনা ফারজানা বলেন, করোনাকাল শুরুর দিকে প্রথম বিদেশ ফেরৎ এক ব্যাক্তির মৃত্যু হয়। তখন লাশের দাফণ কাজ সম্পন্ন করার মত কাউকে পাওয়অ যাচ্ছিলনা। তখন ঢাকা থেকে একটি টিম এসে দাফনের কাজটুক সাড়েন। এরই প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা আসায় স্থানিয় ভাবে কোভিডে মৃত দুই ধর্মেরই ব্যাক্তিদের জন্য সেচ্ছাসেবী টিম গঠন করা হয়। কোভিডে মৃত্যু বরণকারি বেশির ভাগই মুসলিম ধর্মাবলম্ভী হওয়ায় লাশের দাফন কাফনের জন্য এ টিমটি নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা তাদেরকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী দিয়ে যাচ্ছি। আমি যেটা খেয়াল করেছি, নিজ পরিবারের মৃত মানুষটির ধারে কাছেও কেউ আসছেনা , দাফন কাফনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলোও দিতে চায়না। তখন এই টিম নিজেদের আগ্রহে এসে লাশের দাফন কাফন শেষে কবরস্থ করছে এজন্য আমি তাদের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।

করোনা প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সচিব উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো ঃ খোরশিদ আলম বলেন, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে গত ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে এখন পর্যন্ত ৪২ জন মারা গিয়েছেন। আক্রান্তের হার অনেক বেশি।  করোনায় মৃত ব্যক্তিদের দাফন কাফন করতে গিয়ে তাদের পরিবারের সদস্যরা কিছুটা ভয়ভীতি ও শংকায় থাকে। এ কারণে উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্ময়ে একটি সেচ্ছা সেবক টিম গঠন করা হয়েছে লাশের দাফন কার্য সমপন্ন করার জন্য। এই টিমে রয়েছে ৩০ জন সদস্য। শুরু থেকেই তারা গোসল করানো থেকে শুরু করে ৩৬ জনকে দাফন কাফন করেছেন। তবে সস্থির বিষয় যথাযথ ভাবে স্বাস্থ্য বিধি মেনে লাশ দাফণ করায় এখনো পর্যন্ত কেউ আক্রান্ত হয়নি। তাদেরকে আরো সতর্কতার সহিত লাশ দাফন করার জন্য আহ্বান জানাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x