ঢাকা, বুধবার ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১০:০১ অপরাহ্ন
কথাশিল্পী আলাউদ্দিন আল আজাদের প্রয়াণ দিবস স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি
ভাস্কর সরকার

আলাউদ্দিন আল আজাদ বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের প্রথম সোপান বাংলা ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী লেখকদের মধ্যে অন্যতম । সমাজ ঘনিষ্ঠ চরিত্র, আশাবাদ, সংগ্রামী মনোভাব ও নাগরিক জীবনের বিকারগ্রস্থ চেতনা, তাঁর লেখার অন্যতম বিষয়বস্তু। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের যে ভিত্তি নির্মিত হয়ে আছে সেই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আলাউদ্দিন আল আজাদের শিল্প-চেতনার যে বিশেষত্ব পাঠকের চোখে পড়ে তা হচ্ছে, বর্ণনাময় শিল্পমাধুরী, বাক্যগঠনের অভিনবত্ব – সেইসঙ্গে গল্পে প্রতীকধর্মী চিত্রকল্পের ব্যবহার। বাংলাদেশের মাটি মানুষ যেমন কথা বলে তাঁর গল্পের আখ্যানে, তেমনি জীবনের বিভিন্ন দিক উপস্থাপিত হয় কাঠামোর ক্যানভাসে। তাঁর গল্প মূলত জীবনের কথা বলে, দেশ বা জাতির কথা বলে, প্রকৃতি এবং জীবের বৈচিত্র্যময় অবস্থানের কথা বলে।

কবি, লেখক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও শিক্ষাবিদ আলাউদ্দিন আল আজাদ ১৯৩২ সালের ৬ মে নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার রামনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আলাউদ্দিন আল আজাদ তাঁর প্রকৃত নাম নয়। আলাউদ্দিনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লেখক নাম ‘আল আজাদ’। আর তার ডাক নাম ছিল ‘বাদশা’। তাঁর বাবার নাম গাজী আব্দুস সোবহান এবং মা মোসাম্মাৎ আমেনা খাতুন। ১৯৪৭ সালে নারায়ণপুর শরাফতউল্লাহ ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৪৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন আজাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৫৩ সালে স্নাতক ও ১৯৫৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঈশ্বরগুপ্তের জীবন ও কবিতা বিষয়ে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর সরকারি কলেজের অধ্যাপনায় যুক্ত হন। পাঁচটি সরকারি কলেজে অধ্যাপনা এবং পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। এ ছাড়া মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাসে সংস্কৃতি উপদেষ্টা, শিক্ষা সচিব, সংস্কৃতিবিষয়ক বিভাগ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।

আলাউদ্দিন আল আজাদের সাহিত্য চর্চার সূচনা হয়েছিল মাত্র ১৩ বছর বয়সেই। আর ১৯৪৬ সালে তথা বাংলা ১৩৫৪ সনে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত ‘সওগাত’ পত্রিকায় শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রবন্ধ ‘আবেগ’ এবং গল্প ‘জানোয়ার’। তখন তার বয়স মাত্র ১৪ বছর। যেখানে অন্য সবার সাহিত্য চর্চার সূচনা হয় কবিতা অথবা গল্প দিয়ে, সেখানে তার সূচনা হয়েছিল প্রবন্ধ দিয়ে।

১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় আলাউদ্দিন আল আজাদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে শহীদ হন জব্বর, রফিক, সালাম, বরকতসহ আরও অনেকে। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে উঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার দিনে বিক্ষোভকারীদের একজন হিসেবে আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রত্যক্ষ করেন একুশের প্রথম শহীদ রফিকউদ্দিনের নির্মম মৃত্যু। প্রত্যক্ষ করেন আবদুল জব্বার ও আব্দুল বরকতের গুলিবিদ্ধ হওয়ার দৃশ্য।

এরপর ২৪ ফেব্রুয়ারি, দিনটি ছিল রবিবার। সকালের রোদে মেডিকেল হোস্টেলের সামনে সদ্য তৈরি করা শহীদ স্মৃতি স্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মেডিকেল কলেজের কয়েকজন ছাত্র। তারা ভাবলেন কি করে এতো বিনা উপদ্রবে কাজটি শেষ হলো! এক সময় মানুষের ভীড় লাগলো শহীদ স্মৃতি স্তম্ভের দিকে। স্মৃতিস্তম্ভ যেন আন্দোলনকে আরো জোর দিলো। শাসকের প্রতি তীব্র ঘৃণায় যেন তাকিয়ে আছে। ২৪ ও ২৫শে ফেব্রুয়ারি নির্বিঘ্নেই কাটলো। ২৬ তারিখ স্মৃতি স্তম্ভ উদ্বোধন করলেন আইন পরিষদ থেকে ইস্তফা দেয়া আবুল কালাম শামসুদ্দিন। সেদিন বিকেলে পুলিস প্রথমে এসে মেডিকেল ছাত্রাবাস ঘিরে ফেলে। অন্য আরেকদল ট্রাকে করে ভাঙার সরঞ্জামাদি নিয়ে ভিতরে ঢোকে। নুরুল আমিন প্রশাসনের নির্দেশে স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। সশস্ত্র পুলিশের সামনে অসহায় চোখে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না ছাত্রদের। আলাউদ্দিন আল আজাদ তখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতেই ইকবাল হলে বসে তিনি লেখেন স্মৃতিস্তম্ভ কবিতাটি। শুধু শহীদ মিনার নয়, যাদের স্মৃতিতে সেই মিনার, তাদের মৃত্যুকে মহিমাময় করেছেন আজাদ। যে মৃত্যুতে স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে ওঠে, রচিত হয় কবিতা, বাঁধা হয় গান, সে মৃত্যু অমরতার অপর নাম।

স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার?

ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো

চার কোটি পরিবার/ খাড়া রয়েছি তো!

ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক। একটি মিনার গড়েছি আমরা চার কোটি কারিগর/ বেহালার সুরে, রাঙা হৃদয়ের বর্ণ লেখায়।

পলাশের আর/ রামধনুকের গভীর চোখের তারায় তারায় দ্বীপ হয়ে ভাসে যাদের জীবন, যুগে যুগে সেই শহীদের নাম/ এঁকেছি প্রেমের ফেনিল শিলায়, তোমাদের নামে।

তাই আমাদের হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূর্যের মতো জ্বলে শুধু এক শপথের ভাস্কর ॥

তাঁর লেখায় সমাজের গতি ও মানব চরিত্রের বিভিন্ন দিক চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। মানুষ, ভূমি, রাষ্ট্রের কাঠামো ও চরিত্রের অমিত সম্ভাবনার সূত্রাবলী যেন। সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রকাশ পেয়েছে গভীরভাবে। কবিতায় সার্থকভাবে রূপক ও প্রতীক ব্যবহার করেছেন। সর্বোপরি তিনি ছিলেন নিরীক্ষাধর্মী লেখক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১৪৯টি। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- উপন্যাস : তেইশ নম্বর তৈলচিত্র, শীতের শেষরাত বসন্তের প্রথম দিন, কর্ণফুলী, শ্যাম ছায়ার সংবাদ, জ্যোৎস্নার অজানা জীবন, অপর যোদ্ধারা, অন্তরীক্ষে বৃক্ষরাজি, অনূদিত অন্ধকার এবং কালো জ্যোৎস্নায় চন্দ্রমল্লিকা। গল্প : জেগে আছি, ধানকন্যা, মৃগনাভি, অন্ধকার সিঁড়ি, উজান তরঙ্গে, যখন সৈকত এবং আমার রক্ত স্বপ্ন আমার। কবিতা : মানচিত্র, ভোরের নদীর মোহনায় জাগরণ, সূর্য জ্বালার স্বপন এবং লেলিহান পান্ডুলিপি। নাটক : এহুদের মেয়ে, মরোক্কোর জাদুকর, ধন্যবাদ এবং সংবাদ শেষাংশ। প্রবন্ধ : শিল্পের সাধনা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর লেখা : ফেরারী ডায়েরী।

বিভিন্ন ভাষায় আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখার অনুবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ ১৯৭৭ সালে বুলগেরীয় ভাষায় ‘পোত্রেৎ নমের দুবাতসাৎ ত্রি’ নামে অনুবাদ হয়েছে। এ উপন্যাস অবলম্বনে সুভাষ দত্তের পরিচালনায় নির্মিত হয়েছে ‘বসুন্ধরা’ নামে চলচ্চিত্র। অভিনয় করেছেন ববিতা ও ইলিয়াস কাঞ্চন। চলচ্চিত্রটি সাতটি জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। তার কাহিনী থেকে নির্মিত আরেকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র ‘সূর্যস্নান’। এটি বাংলাদেশের প্রথমদিকের চলচ্চিত্রগুলোর একটি। সালাহউদ্দিনের পরিচালনায় নির্মিত ছবিটি ১৯৬২ সালে তেহরান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়। একে ক্লাসিক চলচ্চিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। তার গল্প ‘বৃষ্টি’ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।

তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৪), ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৫), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৭৭), আবুল কালাম শামসুদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), আবুল মনসুর আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৫), রংধনু পুরস্কার (১৯৮৫), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৬), শেরে বাংলা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), নাট্যসভা ব্যক্তিত্ব পুরস্কার (১৯৮৯), কথক একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৯) এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণ পদক (১৯৯৪)।

আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রথম গল্পকার, যিনি অতি অল্প বয়সে খ্যাতি অর্জন করেন ৷ সমাজতন্ত্র ও শ্রেণিচেতনা তাঁর গল্পের প্রধান বিষয়, গ্রামীণ জীবন-সমাজ সেইসঙ্গে পারিপার্শিক পরিবেশের যে পরিচয় তাঁর সাহিত্যে পাওয়া যায়, বিশেষ করে ধর্মান্ধতা কতটা ভেতরে শেকড় বিস্তার করে আমাদের সমাজ জীবনকে অতিষ্ঠ করেছে এবং সেখান থেকে বের হওয়ার যে কোনো রাস্তা অবশিষ্ট নেই, সেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবেশের গল্প তুলে ধরেছেন, এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জানিয়েছেন৷ পাশাপাশি ধনী-গরিবের আকাশ সমান যে বৈষম্য, সেখান থেকে আর কোনো নিস্তার নেই, যদি না সমাজতন্ত্র আসে। করুণা নয়, ভিক্ষা নয়, ফিতরা-জাকাত নয়, চাই ফসলের ন্যায্য অধিকার, চাই বিপ্লব, সম্পদের সুষম বণ্টন, তখনই হবে বন্ধুত্ব-ভ্রাতৃত্ব, সমাজে ফিরে আসবে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি। এই মহান কীর্তিমান কলম যোদ্ধা ২০০৯ সালের ৩ জুলাই ঢাকায় মারা যান। আজ তাঁর ১২ তম মৃত্যুবার্ষিকী৷

x