সিলেটের গোয়াইনঘাটে ঘরের ভেতর স্ত্রী ও সন্তানদের ‘হত্যার পর পাগলামি’ করছেন গৃহকর্তা হিফজুর রহমান। পুলিশ তাকে তার ঘর থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে। এ সময় হিফজুর বিড়বিড় করে বার বার বলছিলেন, ‘চতুর্দিকে মাছ দেখি, মাছ কাটি…’। তিনি মাথা ও পায়ে আঘাত পেয়েছেন, যে কারণে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ ধারণা করছে, হিফজুরের এমন আচরণ অস্বাভাবিক।
গতকাল বুধবার স্ত্রী ও দুই সন্তানের মরদেহের পাশে বিছানা থেকে অজ্ঞান ও আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় হিফজুর রহমানকে। হত্যাকাণ্ডের এ ঘটনায় তাকেই প্রাইম সাসপেক্ট (প্রধান সন্দেহভাজন) হিসেবে দেখছে পুলিশ ও তদন্তকারী সংস্থাগুলো। তদন্তকারীরা মনে করছেন, স্ত্রী সন্তানদের ‘হত্যার পর’ হত্যাকাণ্ডকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে হিফজুর নিজের শরীরে নিজে আঘাত করে মরার মতো পড়ে থাকেন। এ ছাড়া তিনি তার পরিচিত দুই ব্যক্তিকে কল দিয়ে নিজের অসুস্থতার কথা জানিয়ে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার অনুরোধও করেন।
বিভিন্ন সূত্রের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এক ব্যক্তিকে ভোর সাড়ে পাঁচটায় কল দেন হিফজুর। তিনি অসুস্থ এবং ডাক্তারের কাছে যেতে চান এমন তথ্য দিয়ে তাকে সকালে বাড়িতে আসতে বলেন। আটটার দিকে ওই ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত হলে তাদের ঘরের মধ্যে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পান। ধারণা করা হচ্ছে, এর আগে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে জবাই করে হত্যা করেন হিফজুর। এরপর ঠাণ্ডা মাথায় নিজের শরীরে আঘাত করে মৃতের মতো পড়ে থাকেন।
পুলিশ আরও সন্দেহ করছে, হিফজুরের শরীরে কোনো গভীর আঘাতের চিহ্ন না থাকা, বিশেষত হাতে কোনো আঘাত না থাকা তাকে সন্দেহের মূল কারণ। পুলিশ বলছে, একমাত্র সক্ষম পুরুষ হিসেবে প্রতিহত করতে গেলেও হাতে আঘাত পাওয়ার কথা। উপরন্ত, তাকে বিছানা থেকে উদ্ধার করা হলেও তার পায়ে ধুলো ময়লা লেগেছিল। এ অবস্থায় কারও বিছানায় যাওয়ার কথা না।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করে বলেছেন, হিফজুরকে উদ্ধার করে আনার সময় স্থানীয়রা ছবি তুলতে গেলে ফ্লাসলাইটের আলোয় তাকে চোখ পিটপিট করতে দেখা যায়। তার ঘরের দরজাও ভেতর থেকে লাগানো ছিল। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়েছিল ঘরেরই বটি। তাদের এও দাবি, পুলিশ প্রহরায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হিফজুর এখন পাগলামি করে পরিস্থিতি বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল আহাদ বলেন, ‘হিফজুর রহমান এখনো চিকিৎসাধীন। কিছু জিজ্ঞেস করলে তিনি পাগলের মতো আচরণ করছেন। ‘চতুর্দিকে মাছ দেখি, মাছ কাটি’ বলে বিড় বিড় করছেন। যা হত্যার ঘটনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। এছাড়া, বাইরে থেকে কেউ এসে এই বাড়িতে ডাকাতি বা হামলা চালানোর কোনো আলামত এখনো পাওয়া যায়নি।’
ওসি আরও বলেন, ‘চিকিৎসকরা জানিয়েছেন হিফজুরের শরীর কোনো আঘাতই গুরুতর নয়। মাথায় মৃদু আঘাত থাকলেও ইন্টারনাল কোনো আঘাত পাননি তিনি। সেক্ষেত্রে তার পাগলামি কিছুটা অস্বাভাবিক। অনুমান করা হচ্ছে, ভোরের কোনো একসময় স্ত্রী সন্তানকে হত্যা করেন হিফজুর। তারপর কিছুটা ধাতস্থ হলে নিজের মাথা ও পায়ে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে মরার মতো পড়ে থাকেন। তবে এর আগেই দুজনকে কল দিয়ে তিনি অসুস্থ এবং হাসপাতালে যেতে চান বলে বাড়িতে ডাকেন।’
ওসি আহাদ জানান, হিফজুরের সঙ্গে তার জনৈক শ্যালিকার অতি আন্তরিকতা, এক শ্যালিকার বিয়েতে যাওয়া নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া এবং পারিবারিক কলহে স্থানীয়ভাবে সালিসের বিষয়গুলোও আছে বিবেচনায়। এ ছাড়া তার মামার বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে জমি সংক্রান্ত বিরোধের বিষয়টিকেও গুরুত্ব সহকারে দেখছে পুলিশ।
পুলিশ জানিয়েছে, হাসপাতাল থেকে ছাড়া না পাওয়ায় হিফজুরের সঙ্গে এখনও কথা বলা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এই ঘটনার তদন্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হিফজুর রহমান প্রথম থেকেই সন্দেহজনক আচরণ করছেন। প্রথমে আমরা তা বুঝতে পারিনি। তিনি ঘরের ভেতরে অজ্ঞানের ভান করে পড়েছিলেন। তবে হাসপাতালে নেওয়ার পর বোঝা যায় তার আঘাত গুরুতর নয়।
হিফজুরকে সন্দেহের কয়েকটি কারণ উলেখ করে তিনি বলেন, বাইরে থেকে কেউ হত্যার জন্য এলে সাথে করে অস্ত্র নিয়ে আসতো। তাদের ঘরের বটি দা দিয়েই খুন করতো না। বিরোধের কারণে খুনের ঘটনা ঘটলে প্রথমেই হিফুজরকে হত্যা করা হতো কিংবা স্ত্রী সন্তানদের প্রথমে হামলা করলেও হিফুজর তা প্রতিরোধের চেষ্টা করতেন। এতে স্বভাবতই তিনি সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হতেন। অথচ হিফুজরের শরীরের আঘাত একেবারেই সামান্য হিফুজরের শরীরের কিছু জায়গার চামড়া ছিলে গেছে কেবল। এতে আমাদের ধারণা স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা করে ঘটনা অন্যখাতে প্রবাহিত করতে নিজেই নিজের হাত-পা ছিলে ফেলেন বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
তিনি আরও বলেন, সাধারণ ঘুমানোর আগে সবাই হাত পা ধুয়ে ঘুমাতে যান। হিফজুরের স্ত্রী সন্তানদের মরদেহের হাত-পাও পরিষ্কার ছিল। অথচ তার পায়ে বালি ও কাদা লেগে ছিল। এতে বোঝা যাচ্ছে তিনি রাতে ঘুমাননি। তবে কী কারণে হিফজুর তার স্ত্রী সন্তানদের খুন করতে পারেন এ ব্যাপারে কিছু জানাতে পারেননি ওই কর্মকর্তা।
এ ঘটনায় গতকাল বুধবার রাতে নিহত নারীর বাবা আয়ুব আলী বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে গোয়াইনঘাট থানায় মামলা করেছেন। এখন পর্যন্ত কাউকেই গ্রেপ্তার করা হয়নি। ওসি আহাদ বলেন, ‘পুলিশ হত্যার রহস্য উদঘাটনে নিরলসভাবে চেষ্টা করছে। বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করছে পারিবারিক বিরোধের জেরেই এই হত্যাকাণ্ড হতে পারে।’
এদিকে গোয়াইনঘাটে নিহত গৃহবধূসহ তিনজনের ময়নাতদন্ত চলছে। আজ বৃহস্পতিবার সকালে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাদের ময়নাতদন্ত শুরু হয়। তাদের ভিসেরা রিপোর্ট পাওয়া গেলে জানা যাবে নেশা জাতীয় কোনো বস্তু খাওয়ানো হয়েছিল কিনা।
এর আগে গতকাল বুধবার ভোরে সিলেটের সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলায় একই পরিবারের তিনজনের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করা হয়। যে বাড়ি থেকে লাশ গুলো উদ্ধার হয় সেটি হিফজুরের। তিনি তার বাবার বাড়ি ছেড়ে মামার বাড়িতে উপজেলার ফতেহপুরের বিন্নাকান্দি গ্রামে মায়ের তরফ থেকে পাওয়া জমিতে ঘর তুলে বসবাস করতেন।
নিহতরা হলেন হিফজুর রহমানের স্ত্রী আলেমা বেগম (৩৫), ছেলে মিজান (৮) ও মেয়ে তানিশা (৫)। সূত্র দৈনিক আমাদের সময়