ঢাকা, শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৪৩ অপরাহ্ন
ধলঝুড়ি গ্রাম “পুরুষ শূন্য” ব্যবসা, ফসলের মাঠ সামলাচ্ছেন নারীরা
মোঃরিফাত ইসলাম ফরিদপুর

ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার পাচুড়িয়া ইউনিয়নের ধলজুড়ি গ্রাম এখন পুরুষশূন্য। এ গ্রামের কয়েকশ পুরুষ-যুবক-তরুনেরা গ্রেফতার আতংকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গ্রামটি পুরুষ শূন্য হওয়ায় নারীরা কাধে তুলে নিয়েছেন সংসারের হাল। পুরুষশূন্য হওয়ায় গ্রামের নারীরা ভুগছেন চরম নিরাপত্তাহীনতায়। তাছাড়া পুরুষশূন্য হওয়ায় মহিলারা তাদের শিশু সন্তানদের নিয়ে মানবেতর ভাবে দিন কাটাচ্ছে। শুক্রবার সরেজমিন ধলঝুড়ি গ্রাম ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। গত ৪ জুন স্থানীয় এক যুবকের হাতে দুই পুলিশ হামলার শিকার হওয়ায় মামলায় আসামী করা হয়েছে প্রায় দুইশ জনকে। এদের মধ্যে ৪৪ জনের নামউল্লেখ করা হয়েছে। বাকি আসামীদের অজ্ঞাত হিসাবে দেখানো হয়েছে।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গ্রাম আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পাচুড়িয়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান এস এম মিজানুর রহমানের সাথে সম্ভাব্য চেয়ারম্যান প্রার্থী খালিদ মোশাররফ রঞ্জুর বিরোধ চলছে। এ বিরোধের জেরে উভয় গ্রুপের মাঝে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে দু পক্ষই থানায় মামলা করে। গত শুক্রবার (৪ জুন) একটি মারামারির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আলফাডাঙ্গা থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে বরকত নামের মানসিক এক রোগীকে আটক করে। আটকের পর রবকত পুলিশের উপর কিল ঘুষি মেরে হাতকড়া নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় আলফাডাঙ্গা থানার এসআই মঞ্জুর হোসেন ও এএসআই মোঃ জামালউদ্দিন আহত হয়। পরে তাদের স্থানীয় বাজারে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। পুলিশের উপর হামলার ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভাইরাল হয়। ভিডিওটিতে দেখা গেছে, বরকতের সাথে দুই পুলিশের ধস্তাধস্তি হচ্ছে। এক পর্যায়ে দুই পুলিশকে কিল ঘুষি মেরে হাতকড়া নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় বরকত। এ ঘটনার পর পুলিশ বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যানসহ ৪৪ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত ১০০-১২০ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করে। মামলায় পুলিশের উপর হামলার অভিযোগ আনা হয়। পুলিশের উপর হামলা ও মামলার পর ধলঝুড়ি গ্রামে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামে হানা দিয়ে পুলিশ আটক করে বেশ কয়েকজনকে।

শিলা বেগম নামের এক নারী জানান, আমার স্বামী ঘটনার দিন এলাকায় ছিলেন না, অথচ তাকে আসামী করা হয়েছে। সে এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। শিশু সন্তান নিয়ে খুব কস্টের মধ্যে আছি। সোনিয়া বেগম নামের আরেক নারী বলেন, গ্রেফতারের ভয়ে পুরুষ মানুষ বাড়ী ছাড়া। রাতের বেলা সন্তানদের নিয়ে ভয়ের মধ্যে থাকি। চুরি-ডাকাতি হতে পারে সেজন্য রাতে ঘুম আসেনা।

মোসাঃ নিলুফা নামের আরেক নারী বলেন, আমার স্বামী ভ্যানে করে আইসক্রিম বিক্রি করে। মারামারির ঘটনা সে জানেই না। তাকে আসামী করা হয়েছে। এখন সে বাড়ী ছাড়া। ছেলে মেয়ে নিয়ে কস্টের মধ্যে আছি। হাতে টাকা নেই। ঘরে খাবারও নেই। দোকানে এসেছি বাকিতে কিছু কিনতে, দোকানী বাকি দিচ্ছেনা। গ্রামের বেশ কয়েকজন নারী জানান, ঘটনার সাথে যারা জড়িত নন তাদেরও আসামী করা হয়েছে। আবার অনেকেই ভয়ে বাড়ীতে থাকছেনা। গ্রামে পুলিশ এলে সবাই পাটখেতে নেমে পড়ি। ধলঝুড়ি গ্রামের বেশ কয়েকটি দোকান সামলাচ্ছেন নারীরা।

এমন একজন নারী জানান, বাড়ীর পুরুষ মানুষ পালিয়ে আছে। দোকান বন্ধ থাকলে কিস্তি দিবো কেমনে, ছেলে-মেয়ে নিয়ে খাবো কি, তাই দোকানে বসেছি। বেড়িরহাট বাজারে এক ব্যবসায়ী জানান, ঘটনার পর গ্রাম পুরুষ শূন্য। আমরা অন্য এলাকার মানুষ এ হাটে ব্যবসা করি। করোনার সময় এমনিতেই ব্যবসা মন্দা। তার উপর হাটে কেউ আসেনা। বড় বিপদে আছি। গ্রাম্য চিকিৎসক এস এম মারুফ হোসেন বলেন, ঘটনার পর আমি দুই পুলিশ সদস্যকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছি। ঘটনার সাথে যারা জড়িত তার উপযুক্ত বিচার চাই। তবে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেককেই আসামী করা হয়েছে যা কোনভাবেই ঠিক হয়নি। ঘটনার সময় ‘বেড়িরহাট’ বাজারে থাকা কয়েক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সাদা পোষাকে থাকা দুই পুলিশ সদস্য বরকত নামের এক যুবকের হাতে হাতকড়া পড়ায়। এসময় সে পুলিশকে ঘুষি মারেন। এতে দুই পুলিশ আহত হয়। এছাড়া অন্য কোন ঘটনা ঘটেনি। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রামের নিরিহ মানুষকে আসামী করা হয়েছে। তারা জানান, ঢাকায় থাকা, হাসপাতালে ভর্তি থাকা এবং যারা গ্রামেই ছিলেন না তাদের আসামী করা হয়েছে। তারা জেলার পুলিশ সুপার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এক ঘটনার তদন্ত পূর্বক দোষী ব্যক্তির শাস্তি চান।

পাচুড়িয়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড মেম্বার মশিউর রহমান বলেন, মানসিক রোগীর সাথে পুলিশের হাতাহাতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রামের শত শত মানুষকে আসামী করাটা সঠিক হয়নি। মামলার পর গ্রেফতার আতংকে গ্রামটি এখন পুরুষ শূন্য। এ ঘটনার সঠিক তদন্তের পাশাপাশি অহেতুক যাকে কোন ভ্যক্তি হয়রানী না হয় সেজন্য প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করেন। বরকতের চাচা ফারুক হোসেন বলেন, বরকত একজন মানসিক রোগী। তাকে মানসিক রোগের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ঘটনার দিন সাদা পোষাকে পুলিশ তাকে ধরতে এলে সে তাদের বাঁধা দেয়। পরে পুলিশের সাথে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।

পাচুড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এম মিজানুর রহমান বলেন, ঘটনার দিন আমি ঢাকায় ছিলাম। এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমাকেসহ অনেক কেই আসামী করা হয়েছে। সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে সঠিক ঘটনাটি উদঘাটনের দাবী জানান তিনি।

আলফাডাঙ্গা থানার ওসি জানান, পুলিশের উপর হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত ১০ জনকে আটক করা হয়েছে। বাকি আসামীদের আটকের চেষ্টা চলছে। পলাতক থাকার কারনে বাকি আসামীদের আটক করা যাচ্ছে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x