ঢাকা, মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪, ০৪:৪৫ অপরাহ্ন
রাবির বধ্যভূমি : মহান স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ
ভাস্কর সরকার (রাবি)

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শহীদ শামসুজ্জোহা হল থেকে পূর্বদিকে তাকালে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে ইট দিয়ে তৈরী একটি স্তম্ভ দেখা যাবে। দেখতে সাদামাঠা মনে হলেও এর মহত্ব অনেক বেশি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকর্তৃক নিহত হাজারো নিরপরাধ মানুষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গণকবর দেওয়া হয়েছিল স্থানটিতে। তাদের স্মরণেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরী করেছে।

স্মৃতিস্তম্ভটি বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ১৯৭১ সালের ভয়াল দিনগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে গড়ার আহবান জানাচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররা।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজশাহীসহ পাশ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা যেমন নাটোর, বগুড়া, পাবনা এবং রংপুর থেকে শতশত নিরপরাধ মানুষকে এখানে ধরে নিয়ে এসে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়৷ শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এখানে প্রায়  ৮-১০টি গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছিল। স্বাধীনতার পরে বধ্যভূমি খুঁড়ে অসংখ্য হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়। পরে সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় সংরক্ষণ করা হয়। ধারণা করা হয়, ওই গণকবরগুলোতে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা সূত্রে জানা যায়, ১৯৭২ সালের ২৩ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে গণকবর আবিষ্কৃত হয়। সেসময় মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম এবং স্থানীয় কন্ট্রাক্টর জেবর মিয়া গণকবরটি খনন করেন।

জানা যায়, বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য ১৯৯৮ সালে তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. আব্দুল খালেক সরকারের নিকট সুপারিশ করেন। তারপর পরবর্তী উপাচার্য প্রফেসর এম. সাইদুর রহমান খান ১৯৯৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্থানটিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে ১৩টি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের জন্য যে প্রকল্প গ্রহণ করে, তার আওতায় এই প্রকল্পটিও গৃহীত হয়।

২০০০ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন উপাচার্য এম. সাইদুর রহমান খান ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০২ সালের ১৪ ডিসেম্বর তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ফাইসুল ইসলাম ফারুকী এবং ২২ ডিসেম্বর তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ড. রেদোয়ান আহমেদ নির্মাণ কাজ উদ্ভোধন করেন।

বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভে সমতল ভূমি থেকে কংক্রিটের বেদি তৈরি করা হয়েছে। বেদির ঠিক মাঝখানে বড় একটি কূপ। কূপের মাঝখানে দণ্ডায়মান ৪২ ফুট উঁচু এবং ৬ স্তম্ভবিশিষ্ট একটি স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। স্তম্ভটির গায়ে রয়েছে কালো কালো দাগ, যা শহীদদের রক্ত শুকানো দাগের প্রতীক। অন্যদিকে কূপটিকে মৃত্যুকূপের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এ বধ্যভূমি দেখলেই অনুভব করা যায় কি নির্মমতা ঘটেছিল সে সময়।

মূলত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ও আমাদের জাতীয় ইতিহাসে ১৯৪৭-১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান পর্বটির ঘটনা সুদুর প্রসারী। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শোষণ, অত্যাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালিরা ধারাবাহিকভাবে সংগ্রাম চালিয়ে আসছিল। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ ও ১৯৬৪ এর ছাত্র আন্দোলন অন্যতম। এছাড়া ১৯৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন, ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা, সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন,১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ৭০ এর নির্বাচন জাতীয় জাগরণের ক্ষেত্রে ব্যপক ভূমিকা পালন করে, আর এর ফলেই সম্ভব হয়েছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশ ও জাতির সার্বিক মুক্তি অর্জন।

এই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্রষ্টা, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে যুক্তফ্রন্টের হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামসহ মৃত্যু অবধি অসংখ্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন, বিবিসির জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ বাঙালির জীবনে শুভ প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলেই মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভবপর হয়েছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মোট ১১টি সেক্টরের মাধ্যমে যুদ্ধ পরিচালনা করা হয় ৷ এবার সেগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে জানার প্রয়াস পাবো –

১ নং সেক্টর : জিয়াউর রহমান

২ নং সেক্টর : খালেদ মোশারফ

৩ নং সেক্টর : কে এম শফিউল করিম

৪ নং সেক্টর : সি আর দত্ত

৫ নং সেক্টর : মীর শওকত আলী

৬ নং সেক্টর : উইং কমান্ডার বাশার

৭ নং সেক্টর : কাজী নুরুজ্জামান

৮ নং সেক্টর : ওসমান চৌধুরী

৯ নং সেক্টর : মেজর জলিল

১০ নং সেক্টর : কোনো সেক্টর কমান্ডার ছিলনা

১১ নং সেক্টর : কর্নেল তাহের; ইনারা ছিলেন প্রধান।

এছাড়া দল-মত-ধর্ম-বর্ণ- গোত্র নির্বিশেষে বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, আনসার, ইপিআর, পুলিশ এবং বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মজুর, ছাত্র-যুবক, নারী সহো নাম না জানা অসংখ্য নিবেদিত প্রাণ দেশের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন৷ এক্ষেত্রে এক নং সেক্টরের জিয়াউর রহমানের কথা একটু না বললেই নয় ৷ অকুতভয় মেজর জিয়া এবং তার বাহিনী সামনের সারি থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং বেশ কয়েকদিন তারা চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অভিযানের মুখে কৌশলগতভাবে তারা সীমান্ত অতিক্রম করেন। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে প্রথমে তিনি ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন এবং চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, রাঙ্গামাটি, মিরসরাই, রামগড়, ফেনী প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন। তিনি সেনা-ছাত্র-যুব সদস্যদের সংগঠিত করে পরবর্তীতে ১ম, ৩য় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই তিনটি ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রথম নিয়মিত সশস্ত্র ব্রিগেড জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমান, যুদ্ধ পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল হতে জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার এবং তারপর জুন হতে অক্টোবর পর্যন্ত যুগপৎ ১১ নম্বর সেক্টরের ও জেড-ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের জন্য তাকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এছাড়া বঙ্গবীর কাদেরিয়া বাহিনীর অবদানও আমরা অস্বীকার করতে পারিনা৷ এভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলার সর্বোস্তরের জনগণ সমগ্র দেশব্যাপী যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নরঘাতক পাকিস্তানীদের উপর, জাতির পিতার ৭ই মার্চের আদেশ অনুযায়ী৷ আর এই রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকাও অনস্বীকার্য ৷

দীর্ঘ সাড়ে নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত মানুষকে ধরে নিয়ে এসে এখানে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাঁদের স্মৃতি অম্লান করে রাখার উদ্দেশ্যেই এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শহীদ শামসুজ্জোহা হলকে তাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। সেখানে রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে এসে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। এই নরপিশাচদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, শিক্ষার্থী, কর্মচারী এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যরা।

নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবু সাঈদ, রাবির সংস্কৃত ভাষা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার এবং মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মীর আবদুল কাইয়ুমকে। এ ছাড়া গণিত বিভাগের মুজিবর রহমান দেবদাস, ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ড. রাকিব, পরিসংখ্যান বিভাগের কাজী সালেহ এবং বাংলা বিভাগের প্রভাষক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালসহ নাম না জানা অসংখ্য মানুষকে ধরে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। তাদের লালসার শিকার হয় অসংখ্য নারী। এই হলের পেছনে এক বর্গমাইল এলাকাজুড়ে ছিল বধ্যভূমি। এ ছাড়া রাবিসংলগ্ন কাজলা এলাকা এবং রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় পাওয়া যায় আরো কয়েকটি গণকবর।

বাহারি ফুল গাছ দিয়ে ঘেরা এক টুকরো ভূমি। সমতল থেকে বেশ খানিকটা জায়গা উঁচু করে বাঁধানো। এর ভেতরে একটি বড় কূপকে ঘিরে বানানো হয়েছে কংক্রিটের গোলাকার বেদি। কূপের গভীর থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ৪২ ফুট উঁচু ইটের স্তম্ভ। এ স্তম্ভটি বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের এক টুকরো ইতিহাস। পাকিস্তানি বাহিনী আর তাদের এ দেশীয় দোসরদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ভয়াল স্মৃতি। নাম না জানা অসংখ্য শহীদের আত্মত্যাগের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভটি৷

এ বধ্যভূমি এখনো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা মনে করিয়ে দেয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। স্মৃতিসস্তম্ভটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে গড়ার আহ্বান ছড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এখনো প্রতিদিন প্রায় কয়েকশ দর্শনার্থী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বধ্যভূমিতে আসেন এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন ৷

4 responses to “রাবির বধ্যভূমি : মহান স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ”

  1. … [Trackback]

    […] Find More here on that Topic: doinikdak.com/news/20277 […]

  2. ai nude says:

    … [Trackback]

    […] Find More here to that Topic: doinikdak.com/news/20277 […]

  3. Mobile phone remote monitoring software can obtain real – Time data of the target mobile phone without being discovered, and it can help monitor the content of the conversation. https://www.xtmove.com/track-the-location-of-another-phone-without-being-detected/

  4. … [Trackback]

    […] Here you will find 51975 additional Information on that Topic: doinikdak.com/news/20277 […]

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x