ভারতীয় কোম্পানি সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা পাওয়ার অনিশ্চয়তার মধ্যে আমেরিকান কোম্পানি জনসন অ্যান্ড জনসন থেকে করোনাভাইরাসের টিকা কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত সপ্তাহে ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফের মাধ্যমে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে এ টিকা কেনা হবে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. হেলাল উদ্দিন জানিয়েছেন, জনসনের টিকা কেনার বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবে এর প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি। এ জন্য সময় লাগবে।
বর্তমানে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত টিকা দেশের বেক্সিমকো ফার্মার মাধ্যমে আমদানি করছে সরকার। সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে তিন কোটি ডোজ টিকা আমদানির চুক্তি করেছে সরকার। এরই মধ্যে ৭০ লাখ ডোজ টিকা দেশে এসেছে। তবে ভারতের নিজস্ব প্রয়োজন মেটানোর পর রপ্তানি করা হবে- এমন সিদ্ধান্তের কারণে সময়মতো টিকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
যদিও এর আগে একবার ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেও বাংলাদেশ টিকা পেয়েছে। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরকালে টিকা সরবরাহে কোনো অসুবিধা হবে না বলে জানিয়েছেন। এদিকে, ভারত রপ্তানি বন্ধ রাখার কারণে কোভ্যাক্স থেকে যে টিকা পাওয়ার কথা ছিল, তাও সময়মতো পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, কোভ্যাক্স ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা নিয়ে সরবরাহ করবে। এ বৈশ্বিক উদ্যোগের প্রথম দফার টিকা মার্চের প্রথম সপ্তাহে পাওয়ার কথা থাকলেও তা এখন মে মাসে পাওয়া যাবে। মে মাসে কয়েকটি ধাপে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি এক কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার টিকা আসবে। তবে সরকার টিকা পাওয়ার জন্য একটি মাত্র উৎসের ওপর নির্ভর করতে চাইছে না। এ জন্য বিকল্প উৎস হিসেবে জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আরেকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধ করার পর কোভ্যাক্স ই-মেইলে বাংলাদেশকে জানিয়েছে, ভারত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হবে। টিকার সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশের চলমান টিকাদান কর্মসূচি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটেই অক্সফোর্ডের টিকার বিকল্প হিসেবে জনসনের টিকা আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, দেশের কোনো মানুষ যাতে টিকাদান কর্মসূচির বাইরে না থাকে, সে জন্য আরও তিন কোটি ডোজ টিকা আমদানি করতে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই নির্দেশনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে আগে থেকেই জনসনের টিকা কেনার বিষয়ে আলোচনা শুরু করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ভারত ২৫ মার্চ টিকা রপ্তানি বন্ধ করার পর জনসনের টিকা কেনার উদ্যোগে গতি বেড়েছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, অর্থ মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্নিষ্ট সব পক্ষ জনসনের টিকা কেনার বিষয়ে একমত হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ জনসনের টিকা পাওয়া যাবে।
গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার জনসন অ্যান্ড জনসনের তৈরি টিকার অনুমোদন দিয়েছে। এ টিকা সাধারণ রেফ্রিজারেটরে রাখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আক্রান্ত হওয়ার হার ঠেকাতে ৬৬ ভাগ কার্যকর এই টিকা। বেলজিয়ামের প্রতিষ্ঠান জ্যানসেন এটি তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে আগামী জুন নাগাদ ১০ কোটি ডোজ দিতে রাজি হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ টিকা নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে। কোভ্যাক্সও ৫০ কোটি ডোজ নিতে চায়। ফলে আগামী সেপ্টেম্বরের আগে এ প্রতিষ্ঠান থেকে টিকা পাওয়ার সুযোগ নেই।
জনসনের এক ডোজ টিকার দাম ৬ থেকে ১০ মার্কিন ডলার। এ টিকা এক ডোজই যথেষ্ট। বাংলাদেশ আশা করছে, সাত ডলারের মধ্যে প্রতি ডোজ টিকা পাবে। এ টিকা কেনাসহ অন্যান্য কাজে এডিবি ৯৪ কোটি ডলার ঋণ দেবে। এ মাসেই এডিবির সঙ্গে চুক্তি হবে সরকারের। ইউনিসেফের প্রকিউরমেন্ট সাপ্লাই ডিভিশনের মাধ্যমে টিকা কেনা হবে। এ ছাড়া টিকা কেনার জন্য জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা ৫০ কোটি ডলার, এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক (এআইআইবি) ৫০ কোটি ডলার, ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংক ২৫ কোটি ডলার অর্থায়ন করার আগ্রহ দেখিয়েছে। বাংলাদেশের টিকা কেনার কাজে অর্থায়নে ফ্রান্স সরকারও আগ্রহী। তবে দেশটি কী পরিমাণ অর্থায়ন করবে, তা বলেনি।
এদিকে, মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত রোহিঙ্গাদেরও টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মে মাসে কোভ্যাক্সের টিকা আসার পর রোহিঙ্গাদের টিকা দেওয়া শুরু হবে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৪০ বছরের বেশি বয়সী আছেন এক লাখ ২৬ হাজার। চর, পাহাড়ি অঞ্চলের প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকার মানুষ এবং প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়ার জন্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, ধর্মীয় প্রতিনিধি ও এনজিওদের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
বেসরকারি খাতে টিকা :বেসরকারি পর্যায়ে করোনার টিকা আমদানি ও জনগণকে দেওয়ার অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মনে করছে, বেসরকারি খাতের মাধ্যমে টিকা দেওয়া হলে সরকারিভাবে সাধারণ জনগোষ্ঠীকে আরও বেশি পরিমাণ টিকা দেওয়া যাবে। পাশাপাশি সামর্থ্যবান লোকেরা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী টিকা নিতে পারবেন। তবে বেসরকারি খাতকে একটি নীতিমালার আওতায় টিকা আমদানি করতে হবে। বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর যৌথভাবে এ নীতিমালা তৈরির কাজ করছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেসব টিকা আমদানি করবে, তা অবশ্যই বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং দেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদনপ্রাপ্ত হতে হবে। এরই মধ্যে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোর সমিতির পক্ষ থেকে ১০ লাখ ডোজ টিকা আমদানির অনুমোদন চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। একই সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সমিতির পক্ষ থেকেও টিকা আমদানির সুযোগ চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। নিউজ সোর্সঃ