ঢাকা, শুক্রবার ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১১:০৫ অপরাহ্ন
লাইলাতুল বরাত (পবিত্র শবে বরাত)
Reporter Name

মো: কামাল উদ্দীন মৌলভীবাজার: ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত এবং ‘বরাত’ শব্দের অর্থ সৌভাগ্য। আরবি ‘লাইলাতুল বরাত’ মানে সৌভাগ্যের রাত। এই রাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পরম করুণাময়ের অনুগ্রহ লাভের আশায় বেশি বেশি নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, জিকিরে মগ্ন থাকেন। অনেকে রোজা রাখেন, দান-খয়রাত করেন। অতীতের গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা এবং ভবিষ্যৎ জীবনের কল্যাণ কামনা করে মোনাজাত করেন মুসলমানরা।

শবে বরাত উপলক্ষে নফল রোজা রাখা, নফল নামাজ পড়া, কিরাত ও রুকু-সিজদা দীর্ঘ করা; কোরআন তিলাওয়াত করা; দরুদ শরিফ বেশি বেশি পড়া; ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা; দোয়া-কালাম, তাসবিহ তাহলিল, জিকির-আসকার ইত্যাদি করা; কবর জিয়ারত করা; নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সব মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করা। মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় এই মহান রাতে ইবাদতের মাধ্যমে আমরা আমাদের পাপের বোঝা কমিয়ে নিতে পারবো।

লাইলাতুল বরাতের ফজিলত : শবেবরাতের ব্যাপারে হাদিস-

১. হজরত আয়শা রা: বলেন, এক রাতে রাসূল সা:কে না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকিতে (মদিনার কবরস্থান) গিয়ে আমি তাঁকে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, কী ব্যাপার আয়শা? (তুমি যে তালাশে বের হলে?) তোমার কি মনে হয় আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তোমার ওপর কোনো অবিচার করবেন? হজরত আয়শা রা: বললেন, ‘আমার ধারণা হয়েছিল আপনি অন্য কোনো বিবির ঘরে গেছেন। রাসূল সা: তখন বললেন, যখন শাবান মাসের ১৫ রাত আসে অর্থাৎ যখন শবেবরাত হয়, তখন আল্লাহ পাক এ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। তারপর বনু কালব গোত্রের বকরির পশমের চেয়ে বেশি সংখ্যক বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি : ৭৩৯, আহমাদ : ২৬০২৮)। মানুষ মাত্রই ভুলের মধ্যে রয়েছে। ফেতনার এমন সঙ্কটময় সময়ে রবের কাছে সার্বক্ষণিক ক্ষমা প্রার্থনা মুমিন ব্যক্তিদের জন্য আবশ্যক। মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য রাতের ইবাদত অত্যন্ত ফলপ্রসূ, এই লক্ষ্যে যদি এ রাত আল্লাহর স্মরণে অতিবাহিত হয় তবে তা মুমিনের জন্য কল্যাণকরই হবে।

২. হজরত মুয়াজ বিন জাবাল রা: থেকে বর্ণিত রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘অর্ধ শাবানের রাতে (শবেবরাতে) আল্লাহ তায়ালা তাঁর সব মাখলুকের প্রতি মনোযোগ আরোপ করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষভাবাপন্ন ব্যক্তি ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন’ (ইবনে হিব্বান : ৫৬৬৫, মুসনাদুল বাজ্জার : ২৭৫৪, ইসহাক বিন রাহওয়াই : ১৭০২, আল মুজামুল আওসাত:৬৭৭৬, আল মুজামুল কাবির:২১৫, ইবনে মাজাহ : ১৩৯০)।
আল্লাহ ১৫ শাবান রাতে অপেক্ষা করেন বান্দাদের মধ্য থেকে অধিক সংখ্যককে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য। বর্ণিত হাদিসটি হোক হাসান বা সহিহ, যেখানে রবের ইবাদত করে তাকে সন্তুষ্ট করার ইচ্ছা পোষণে আরো কি কোনো উদাহারণ পেশের প্রয়োজন আছে মনে করি না।

৩. হজরত আয়শা রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সা: কে শাবান মাসের মতো এত রোজা অন্য মাসে রাখতে দেখিনি’ (নাসায়ি : ২১৭৯ সহিহ)। সহিহ মুসলিম গ্রন্থের ২৬৫৩ ও মিশকাতের ৭৯ এবং অন্যান্য সহিহ হাদিস দিয়ে প্রমাণিত, তবে অবশ্যই এ কথা বলা যাবে না যে, রোজা একটি রাখা লাগবে বা বেশি রাখা লাগবে। শাবানের শুরু থেকে শেষ দুই-তিন দিন আগে পর্যন্ত রোজা রাখা যাবে।

৪. হজরত আলী রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেছেন- ‘মধ্য শাবান এলে তোমরা রাতে ইবাদত করো আর দিনে রোজা রাখো’ (ইবনে মাজাহ : ১৩৮৮)।
এ হাদিস থেকে জানা গেল; শবেবরাতের দিনে রোজা রাখা ও রাতে নামাজ পড়ার বিশেষ তাকিদ, হাদিসটি যদিও জয়িফ তবে এর বিপরীত এমন কোনো সহিহ হাদিস নেই যেখানে বলা হয়েছে- এ রাতে নামাজ পড়া যাবে না এবং দিনে রোজা রাখা যাবে না। সুতরাং বলা যায়, শবেবরাত একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত। এ রাতে অধিক নামাজ পড়া উত্তম, দিনে রোজা রাখা সওয়াবের। শবেবরাতে রাতে ইবাদত এবং দিনে রোজা রাখায় কোনো নিষিদ্ধতা নেই শরিয়তে, এ রাতের ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করা হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে এ রাতে ইবাদত করা মুস্তাহাব।

মোল্লা আলী কারি রহ: বলেন- সবাই একমত যে, জয়িফ হাদিস ফজিলত হাসিল করার জন্য আমল করা জায়েজ আছে (আলমাওজুআতুল কাবির : ১০৮ পৃষ্ঠা)। আল্লামা ইবরাহিম হালবি রহ: বলেন- জয়িফ হাদিস দ্বারা সব আমলই মোস্তাহাব। যেমন- গোসলের পর রুমাল দিয়ে শরীর মোছা মোস্তাহাব। (গুলিয়াতুল মুস্তামালি ফি শরহি মুনিয়াতুল মুসল্লি, তিরিমিজি-১/১১২ পৃষ্ঠা)।

শবেবরাত সম্পর্কে মুহাক্কিকদের অভিমত : ১.ফিকহে হানাফির আল্লামা শামি ইবনে নুজাইম, আল্লামা শারামবুলালি আবদুল হক মুহাদ্দেসি দেহলভী, আশরাফ আলী থানবী, আবদুল হাই লাখনোভী মুফতি মুহাম্মদ শফিসহ বর্তমান বিশ্বের অন্যতম মুহাক্কিক আলেম বিচারপতি মুফতি তকি উসমানি দা. বা. বলেন, শবেবরাতে শক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী জাগ্রত থেকে একাকীভাবে ইবাদত করা মুস্তাহাব’ (সূত্র : আদদুররুল মুখতার : ২/২৪-২৫, আর বাহরুর রায়িক : ২/৫২, মা ছাবাতি বিসসুন্নাহ : ৩৬, মারাক্কিল ফালাহ : ২১৯, জাওয়ালুস সিনাহ : ১৭)।

২.মাম শাফেয়ি রহ: বলেন, শাবানের ১৫তম রাতে বশি বেশি দোয়া কবুল হয়ে থাকে (কিতাবুল উম্ম-১/২৩১)।

. ইবনে রজব হাম্বলি রহ: বলেন, শবেবরাতে ইবাদত করা মুস্তাহাব। (আল মাবদি-২/২৭, কাশফুল কিনা-১/৪৪৫)।

৪. ইমাম হাজ মালিকি রহ: বলেন, সালফে সালিহিরা এ রাতকে যথেষ্ট সম্মান করতেন এবং এর জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন (আল মাদখাল-১/২৯২-৯৩)।

৫. শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ রহ: বলেন, ‘অর্ধ-শাবান দিবাগত রাতের ফজিলত বিষয়ে অনেক হাদিস ও আসর আছে, যা প্রমাণ করে, এটি একটি ফজিলতপূর্ণ রাত এবং সালাফের অনেকেই এ রাতে নামাজের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। (ইকতিজাউস সিরাত-১/৩০৩)। আনোয়ার শাহ কাশ্মিরি রহ: বলেন, ‘শবেবরাতের ব্যাপারে অনেক সহিহ বর্ণনা আছে’ (শাজি-২/৪৯)। এ ছাড়া ইবনে মুনজির, ইমাম তাবারানি, নুরুদ্দীন হাইসামি রহ:সহ অনেক মুহাক্কিক শবেবরাতের ব্যাপারে কথা বলেছেন এবং আমল করেছেন ও আমল করতে উৎসাহ দিয়েছেন।

নিসফুশ শাবান কেন্দ্র করে রাত জেগে আমল করা বা পর দিন রোজা রাখার মধ্যে পুণ্য রয়েছে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বান্দার সরিষা পরিমাণ আমলেরও প্রতিদান দেবেন। যিনি সরিষা পরিমাণ আমলেরও প্রতিদান দেবেন তাঁর ইবাদত করার ক্ষেত্রে কেন আমরা এ রাতের বিষয়ে রেফারেন্স তালাশে ব্যস্ত থাকব। আমলের বিষয়ে আল্লাহ জানুক, আমল করা হোক। আল্লাহ আমাদের সবাইকে অতিরঞ্জিত সব বিষয় থেকে হিফাজত করুন, আমীন

 

x