বাংলাদেশে তামাকের কর বৃদ্ধি একইসাথে মানুষের জীবন বাঁচাবে ও সরকারের রাজস্ব বাড়াবে। তামাকের ব্যবহার কমানোর সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো কর বাড়ানোর মাধ্যমে তামাকপণ্যের দাম বাড়ানো, যাতে এসব পণ্য কেনা সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিগারেটের চার মূল্যস্তর ব্যবস্থা বাতিল করে দুই স্তরে আনতে হবে। শুধু তাই নয়, এর সবকিছুর সাথে সাথে তামাক কর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে, যা তামাকের ব্যবহার হ্রাসের পাশাপাশি রাজস্ব আয় বাড়াবে।
তামাক মৃত্যুর কারণ
এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০১৮ সালে তামাকজনিত রোগে প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে যা মোট মৃত্যুর ১৩ দশমিক পাঁচ শতাংশ। ২০০৪ সালে পঙ্গুত্ব বরণ করে আরও প্রায় চার লাখ মানুষ।
২০১৭ সালে আরেক গবেষণায় দেখা যায়, ধূমপান না করেও নারীরা ১৯ শতাংশ কর্মক্ষেত্রে, ৩৮ শতাংশ গণপরিবহনে এবং ৩৭ শতাংশ বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন এবং ঢাকার প্রাথমিক স্কুলে পড়া ৯৫ শতাংশ শিশুর দেহে পাওয়া গেছে। ২০১৮ সালে আরেক সমীক্ষায় বলা হয়, উচ্চমাত্রার নিকোটিন বিড়ি কারখানাগুলোর মোট শ্রমিকের ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ শিশু শ্রমিক।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, অথচ একই সময়ে (২০১৭-১৮) তামাকখাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের পরিমাণ মাত্র ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। পরিবেশ এবং কৃষকের জীবন-জীবিকার উপর তামাক চাষের বিরূপ প্রভাব ব্যাপক।
বৃটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর (বিএটিবি) ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ২০১৯ সালে তারা কর বাবদ সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে ২২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা, যার মধ্যে প্রত্যক্ষ কর; অর্থাৎ যেটা বিএটিবি’র পকেট থেকে এসেছে তার পরিমাণ মাত্র ১০৮২ টাকা। অর্থাৎ, কোম্পানি নয়; ভোক্তাই তামাকের কর দিয়ে থাকে। তাই তামাক কোম্পানিগুলো বেশি কর দেয়; এই ভাবনাটা একেবারেই অমূলক। যেহেতু বাংলাদেশের বর্তমান তামাক কর কাঠামো অনেকটাই জটিল; তামাক সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সেই সুযোগটিই নিয়ে থাকে।
সিগারেটের চার মূল্যস্তর ব্যবস্থা বাতিল করে দুই স্তরে আনতে হবে
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ’র (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ধূমপান কমাতে সিগারেটের স্তর সংখ্যা কমানোর বিকল্প নেই। আসন্ন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সিগারেটের বিদ্যমান চার মূল্যস্তর ব্যবস্থা বাতিল করে দুই স্তরে আনতে হবে। কারণ একাধিক মূল্য স্তর এবং বিভিন্ন দামে সিগারেট কেনার সুযোগ থাকায় ভোক্তা স্তর পরিবর্তন করার সুযোগ পায়। ফলে তামাক ব্যবহার হ্রাসে কর ও মূল্য পদক্ষেপ সঠিকভাবে কাজ করে না। পাশাপাশি তামাক কর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে, যা তামাকের ব্যবহার হ্রাসের পাশাপাশি রাজস্ব আয় বাড়াবে।
তিনি বলেন, সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের চাকরিতে শারীরিক ফিটনেসের একটা অংশ থাকতে হবে তিনি ধূমপান করেন কিনা। ধূমপান করতে তার নেগেটিভ মার্ক হবে। এটা সরকারের উন্নয়ন প্রোগ্রামের অংশ হতে পারে।
‘জর্দা ও গুলের ওপরও বেশি কর বাড়ানো উচিত। বাংলাদেশের বাজারে সিগারেট অত্যন্ত সস্তা ও সহজলভ্য। বিশ্বের ১৫৭টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম মূল্যের সিগারেট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ১০২তম। প্রতি অর্থবছরে সিগারেটের ওপর করারোপ করা হলে তাতে মূলত দামের পরিবর্তন আসে ব্র্যান্ডের সিগারেটের ওপর।’
কেমন তামাক কর চাই
২০২১-২২ অর্থবছরে তামাক কর প্রস্তাব এবং সুপারিশে তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) জানায়, সিগারেট ও বিড়িসহ সকল প্রকার তামাকপণ্যের খুচরা মূল্যের উপর ১৫% মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং ১% স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বহাল রাখা প্রয়োজন।
বাজেটে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের নিম্ন স্তরে খুচরা মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৩২.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ করতে হবে; মধ্যম স্তরে খুচরা মূল্য ৭০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ করতে হবে; উচ্চ স্তরে খুচরা মূল্য ১১০ টাকা নির্ধারণ করে ৭১.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক এবং প্রিমিয়াম স্তরে ১৪০ টাকা খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে ৯১ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করতে হবে। এর ফলে সকল মূল্যস্তরে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কের হার হবে চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৬৫%।
বিড়ির ক্ষেত্রে, ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১১.২৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ করতে হবে; ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করে ৯.০০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ করতে হবে। ফলে উভয় ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কের হার হবে চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৪৫%।
জর্দা বা গুলের মতো ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যে সবচেয়ে কম করারোপ করা হয়। আসন্ন বাজেটে প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৪৫ টাকা নির্ধারণ করে ২৭.০০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ; প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১৫.০০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ করতে হবে। এতে করে উভয়ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কের হার হবে চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৬০%।
প্রজ্ঞা বলছে, এই সব সুপারিশগুলো কার্যকর হলে প্রধানমন্ত্রীর তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথে আমরা আরও একধাপ এগিয়ে যাবো। সিগারেটের ব্যবহার ১৫.১% থেকে হ্রাস পেয়ে ১৪.১% নেমে আসবে। প্রায় ১১ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী ধূমপান ছাড়তে উৎসাহিত হবে এবং আট লাখের বেশি তরুণ ধূমপান শুরু করতে নিরুৎসাহিত হবে। দীর্ঘমেয়াদে তিন লাখ ৯০ হাজার বর্তমান ধূমপায়ী এবং চার লাখ তরুণের অকাল মৃত্যু রোধ সম্ভব হবে। বিগত অর্থবছরের চেয়ে সম্পূরক শুল্ক, স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ এবং ভ্যাট বাবদ তিন হাজার ৪০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জিত হবে, অর্থাৎ প্রথম বছরে সিগারেট খাত থেকে ১২% বাড়তি রাজস্ব আয় হবে।
মানুষের পকেটে টান পড়তে হবে
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও জাতীয় তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, কর হতে হবে আয় বৃদ্ধির থেকে বেশি, যাতে মানুষের পকেটে টান পড়ে। প্রতি বছর আমরা যে ফাঁকিটা দেখি তা হলো তামাকের দাম বাড়ে কিন্তু আয় বৃদ্ধির থেকে বেশি হয় না, ফলে মানুষের পকেটে টান পড়ে না।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন আইনটা এমনভাবে করতে হবে যাতে ২০৪০ সালের মধ্যে দেশ তামাকমুক্ত হয়। তামাক গ্রহণের হার হিসেবে কিছুটা কমলেও সংখ্যা হিসেবে কমছে না। এভাবে চলতে থাকলে লক্ষ্য অর্জন হবে না।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে ড. নাজনীন আহমেদ বলেন: তামাক কর কাঠামো সংস্কার করা হলে তা স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন খাতের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগান দেবে। স্পষ্টতই এটি সরকারের পাশাপাশি বাংলাদেশের জনগণের জন্যও লাভজনক হবে।
এর পাশাপাশি তামাক নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রমের ওপরও প্রচার প্রচারণার গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
আসন্ন বাজেটে তামাক জাত পণ্যের কর বাড়ানো বিষয়ে সরকারের ভাবনা কী? এমন প্রশ্নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় নি। নিউজ সোর্সঃ