করোনার তীব্র সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সাত দিন নয়, কমপক্ষে ১৪ দিন (দুই সপ্তাহ) লকডাউন দেওয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, যে ভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড (সংক্রমিত করার সময়) ১৪ দিন। সেই ভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে ৭ দিনের লকডাউন অবৈজ্ঞানিক। তাছাড়া লকডাউন ঘোষণার পর সারা দেশের আন্তঃজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখতে হবে। অর্থাৎ সড়ক, নৌ, রেল ও বিমান যোগাযোগ নির্ধারিত সময় পর্যন্ত কার্যকর অর্থেই নিষিদ্ধ থাকবে। শুধু তাই নয়, রাত ৮টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখা অত্যাবশ্যক। অন্যথায় সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব নয়।
ভয়াবহ সংক্রমণ রোধে আগামীকাল থেকে সারা দেশে প্রথমবারের মতো সাত দিনের লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ২২ মার্চ থেকে দেশে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ মারাত্মক ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। বিগত ৮ দিনের সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের মোট সংক্রমণের চেয়ে বেশি। গত ২৯ মার্চ সরকার ১৮ দফা নির্দেশনা প্রদান করলেও তা জোরালো প্রতিক্রিয়া তৈরি করেনি। ফলে মাঠ পর্যায়ে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন না ঘটায় সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে সাধারণ শয্যা ও আইসিইউ শয্যার তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। এমনকি দেশব্যাপী চিকিৎসা এবং পরীক্ষায় জড়িত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে লকডাউন দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু ভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড (সংক্রমণ সময়) ১৪ দিন। তাই লকডাউন ১৪ দিন দিতে হবে। সাত দিনের লকডাউন সংক্রমণের হার কমাতে কার্যকর হবে না। লকডাউন ঘোষণার পাশপাশি যে বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে, সেটি হলো- সব ধরনের আন্তঃজেলা পরিবহণ বন্ধ রাখা। যাতে কেউ নিজ শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি যেতে না পারে। তাহলে আবার সংক্রমণ দ্রুতগতিতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে সংক্রমণের যে হার, তাতে বাসায়ও সবার মাস্ক পরা উচিত। এমনকি একসঙ্গে এক টেবিলে বসে খাওয়া পরিহার করতে হবে। কারণ একজন একজনের ভেতর ভাইরাস থাকলে সেটা পুরো পরিবারে ছড়িয়ে পড়বে। তিনি বলেন, মাত্র ১৪ দিন একটু কষ্ট মেনে নিলে দেশের সংক্রমণের হার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে লকডাউন আরোপের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে সরকারের বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, গত ২২ মার্চ থেকে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ মারাত্মক ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। যা ইতোমধ্যে প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত আট দিনে দেশে কোভিডে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪২ হাজার ১৪৫ জন। এই সময়ে মৃত্যু হয়েছে ৩৮৩ জনের। পাশাপাশি সংক্রমণের হার ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৩ দশমিক ১৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বিগত ৮ দিনের সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের মোট সংক্রমণের চেয়ে বেশি। এমনকি দেশে সংক্রমণ শুরুর পর থেকে দৈনিক সর্বোচ্চ আক্রান্তের দিক থেকে প্রথম ৬টি স্থানেই রয়েছে গত ৬ দিনের (২৯ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল) সংক্রমণের পরিমাণ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, চলমান ঊর্ধ্বগতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে গত ২৫ মার্চ প্রেরিত সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ২৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১৮ দফা নির্দেশনা প্রদান করে। তবে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে তা জোরালো প্রতিক্রিয়া তৈরি করেনি। তারা চলমান ঊর্ধ্বগতির তীব্রতা ও ভয়াবহতা বুঝতে না পেরে সচেতন হয়নি। ফলে মাঠ পর্যায়ে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন না ঘটায় সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে।
এতে সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা অনেকাংশে বেড়েছে। বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে সাধারণ শয্যা ও আইসিইউ শয্যার তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় দেশের সব হাসপাতালে কোভিড ইউনিট চালু এবং বিদ্যমান সব আইসিইউ কোভিড চিকিৎসায় ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। কোভিডের চলমান ঊর্ধ্বগতি হ্রাস করতে না পারলে আক্রান্ত রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা প্রদান করা ক্রমেই দুরূহ হয়ে পড়বে। সামগ্রিকভাবে বিশিষ্ট ভাইরাসবিদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সাত দিন বা ১০ দিনের লকডাউন ঘোষণা করা অবৈজ্ঞানিক। কারণ এই ভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪ দিন বা ১৫ দিন। তাই লকডাউন দিলে অবশ্যই ১৪ দিনের দিতে হবে। অন্যথায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে ১ জুন পর্যন্ত সারা দেশ সাধারণ ছুটিরও আওতায় আনা হয়। তবে আগামীকাল সোমবার থেকে দেশে প্রথমবারের মতো সাত দিনের জন্য লকডাউন কার্যকর করতে যাচ্ছে সরকার। যদিও করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতা বিবেচনা করে বিশ্বের অনেক দেশেই দফায় দফায় লকডাউন দেওয়া হয়। নিউজ সোর্সঃ
Leave a Reply