ঢাকা, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৪:৫৬ পূর্বাহ্ন
বন্ধুগণ, এতদিন স্বদেশ আমাদের কাছে একটা শব্দমাত্র
Reporter Name

বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশ—এসব নিয়ে ভাবতে বসলে আমাদের যেতে হয় রবীন্দ্রনাথের কাছে। ১১২ বছর আগে দেশভাবনার যে আকুতি তিনি প্রকাশ করেছিলেন, তা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করার জন্য পাকিস্তান নামক একটি মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে আমাদের থাকতে হয়েছিল ২৩ বছর। বাংলা ১৩১২ সালের কার্তিক মাসে বিজয়া-সম্মিলনে তিনি বলেছিলেন:

বন্ধুগণ, এতদিন স্বদেশ আমাদের কাছে একটা শব্দমাত্র, একটা ভাবনামাত্র ছিল—আশা করি, আজ তাহা আমাদের কাছে বস্তুগত সত্যরূপে উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে।কারণ, যাহাকে আমরা সত্যরূপে না লাভ করি তাহার সহিত আমরা যথার্থ ব্যবহার স্থাপন করিতে পারি না, তাহার জন্য ত্যাগ করিতে পারি না, তাহার জন্য দুঃখ স্বীকার করা আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়।তাহার সম্বন্ধে যতই কথা শুনি, যতই কথা কই, সমস্তই কেবল কুহেলিকা সৃষ্টি করিতে থাকে।এই-যে বাংলাদেশ ইহার মৃত্তিকা, ইহার জল, ইহার বায়ু, ইহার আকাশ, ইহার বন, ইহার শস্যক্ষেত্র লইয়া আমাদিগকে সর্বতোভাবে বেষ্টন করিয়া আছে—যাহা আমাদের পিতা-পিতামহগণকে বহুযুগ হইতে লালন করিয়া আসিয়াছে, যাহা আমাদের অনাগত সন্তানদিগকে বক্ষে ধারণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আছে, যে কল্যাণী আমাদের পিতৃগণের অমর কীর্তি অমৃতবাণী আমাদের জন্য বহন করিয়া চলিয়াছে, আমরা তাহাকে যেন সত্য পদার্থের মতোই সর্বতোভাবে ভালোবাসিতে পারি—কেবলমাত্র ভাবসম্ভোগের মধ্যে আমাদের সমস্ত প্রীতিকে নিঃশেষ করিয়া না দিই। আমরা যেন ভালবাসিয়া তাহার মৃত্তিকাকে উর্বর করি, তাহার জলকে নির্মল করি, তাহার বায়ুকে নিরাময় করি, তাহার বনস্থলীকে ফলপুষ্পবতী করিয়া তুলি, তাহার নরনারীকে মনুষ্যত্বলাভে সাহায্য করি।…

রবীন্দ্রনাথ তাঁর কথা শেষ করেছিলেন একটি প্রার্থনা-সংগীত দিয়ে। তার শেষ পঙ্‌ক্তিগুলো ছিল:

বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন,

বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন,

এক হউক এক হউক

এক হউক হে ভগবান।

রবীন্দ্রনাথ বাঙালিকে একটি অভিভাজ্য সত্তা হিসেবে দেখেছিলেন।সেই সত্তাটি দুই টুকরো হয়ে গিয়েছিলে ১৯৪০-এর দশকে রাজনীতিবিদদের হাতে।বাঙালি ভোট দিয়ে নিজেদের ভাগ করেছিল।পরিচিত প্রতিবেশীকে ছেড়ে হাজার মাইল দূরের অপরিচিতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিল। এই সমীকরণের পক্ষে দাঁড় করানো হয়েছিল নানান তাত্ত্বিক যুক্তি।কিন্তু মোহভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। বাঙালির আত্মায় ঘা পড়েছিল।আর তখনই জন্ম হয়েছিল নতুন উপলব্ধির।ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানি বাঙালির মধ্যে নতুন বোধের স্ফুরণ ঘটল।

রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল পাকিস্তানের জন্ম হওয়ার আগেই।১৯৪৭ সালের ৩ জুন ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন যখন ভারতভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, বাংলা ভাষাভাগের বিষয়টি তখনই ফয়সালা হয়ে গিয়েছিল।জুন মাসের প্রথম দিকেই সংবাদপত্রে খবর বেরোয় যে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চাইছেন। কয়েকজন বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবী এর বিরোধিতা করে প্রবন্ধ লেখেন।তাঁদের মধ্যে ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, আবদুল হক, ফররুখ আহমদ, আবুল হাশিম প্রমুখ।উদু‌র্র বিরোধিতা করে এবং বাংলা ভাষার পক্ষে প্রথম প্রবন্ধ লিখেছিলেন আবদুল হক। ‘বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব’ শিরোনামে তাঁর লেখাটি দৈনিক ইত্তেহাদ-এর রবিবাসরীয় বিভাগে দুই কিস্তিতে ছাপা হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ২২ ও ২৯ জুন।‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ নামে তাঁর দ্বিতীয় প্রবন্ধটি ৩০ জুন দৈনিক আজাদ-এ ছাপা হয়। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিবৃতি দিলে জুলাইয়ের (১৯৪৭) শেষ দিকে এর বিরোধিতা করে ড. শহীদুল্লাহ্‌ দৈনিক আজাদ-এ একটি প্রবন্ধ লেখেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্রটি জন্ম নেওয়ার আগেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে এসব লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। সুতরাং বলা চলে, পরে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যে সূচনা হয়েছিল, তার পটভূমি তৈরি করেছিলেন বুদ্ধিজীবীরা।

One response to “বন্ধুগণ, এতদিন স্বদেশ আমাদের কাছে একটা শব্দমাত্র”

  1. Hi, i think that i saw you visited my website so i came to
    “return the favor”.I am trying to find things to improve my web site!I suppose its ok to use some of your ideas!!

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x