ঢাকা, শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:১৪ পূর্বাহ্ন
সাবেক অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমানের ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
দৈনিক ডাক অনলাইন ডেস্ক

সিলেটের এক যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে বিলেতে গেছেন পড়তে। তার স্বপ্ন ব্যারিস্টার হওয়া। সময়টা ১৯৫৩ সাল। বিলেতে গিয়ে তার মন পাল্টে যায়। তিনি সি.এ কোর্সে ভর্তি হোন এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ভালো রেজাল্ট করে চার্টার্ড একাউন্টিং পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি আর্থিক ও মুদ্রানীতি এবং উন্নয়ন অর্থনীতিতে বিশেষায়িত শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে যখন তিনি স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে আসেন তখনও পুরো পাকিস্তানে চার্টার্ড একাউন্টেন্টের সংখ্যা হাতে গোনা। আকাশছোঁয়া বেতনে তার চাকুরী হয় ব্রিটিশ অক্সিডেন্টাল কোম্পানীতে। কোম্পানীর অফিস পাকিস্তানের করাচীতে। করাচীর বিলাশবহুল জীবনেও তার মনে শান্তি ছিলোনা। তিনি চোখ মেললেই দেখতে পেতেন পশ্চিম পাকিস্তানীরা কিভাবে পূর্ব পাকিস্তানীদের শোষণ করছে- বিশেষত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে।

১৯৬২ সালে শেকড়ের টানে উচ্চ বেতনের চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন তিনি এবং ঢাকায় দুই বন্ধুকে সাথে নিয়ে গঠন করেন সি.এ ফার্ম, নাম- রহমান হক এন্ড কোম্পানী। অত্যন্ত অল্প সময়ের মাঝে এই প্রতিষ্ঠান পুরো পাকিস্তানের মাঝেই অন্যতম শীর্ষস্থানীয় চার্টার্ড একাউন্টিং ফার্ম হিসেবে সুনাম অর্জন করে। অর্থনীতির সকল অঙ্গনে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। যে যুবক একদিন বিলেতের জীবন ফেলে, উচ্চ বেতনের চাকুরী ছেড়ে নিজের মাটিতে ব্যবসা করার সাহস দেখিয়েছিলেন, কে জানতো একদিন তার হাত ধরে এই দেশের কোটি কোটি পরিবারের অর্থনীতির চাকা সঠিক পথে ঘুরতে শুরু করবে? তার নাম এম. সাইফুর রহমান- বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা অর্থমন্ত্রী, এক কিংবদন্তী।

তার জন্ম ১৯৩২ সালে মৌলভীবাজারের বাহারমর্দান গ্রামে। তার বাবা ছিলেন শিক্ষক। সাইফুর রহমানের বয়স যখন মাত্র ৬ বছর, তখন তার বাবা মারা যান। চাচা তাকে পূত্র স্নেহে লালন-পালন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে এম. সাইফুর রহমান ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার জন্য তিনি গ্রেফতার হন এবং এক মাস কারাবরণ করেন। স্বাধীন দেশে জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমন্ত্রণে ১৯৭৬ সালে ভাষা সৈনিক এম. সাইফুর রহমান সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হোন এবং প্রথমে বানিজ্য উপদেষ্টার পদ লাভ করেন।

১৯৭৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে বি.এন.পি সরকার গঠন করলে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মন্ত্রীসভায় এম. সাইফুর রহমান অর্থ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিযুক্ত হোন। ১৯৮২ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারী করলে বিএনপি নেতাকর্মীদের উপর শুরু হয় নির্যাতন। সেই সময় বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সকল নেতার সাথে এম. সাইফুর রহমানকেও গ্রেফতার করে সীমাহীন নির্যাতন করা হয়। এরশাদ সাহেব সাইফুর রহমানকে তার মন্ত্রীসভায় যোগদান করার প্রস্তাব দিলেও তিনি নীতির প্রশ্নে আপোষ করেননি। ১৯৯১-৯৬ সালে বেগম খালেদা জিয়ার সরকারেও তিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন এবং ২০০১-০৬ মন্ত্রীসভায় তিনি দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, একাধারে তিনি ছিলেন অর্থমন্ত্রী এবং পরিকল্পনামন্ত্রী।

তিনি দেশের হয়ে রেকর্ড ১২ টি বাজেট পেশ করেন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আর্কিটেক্ট এম. সাইফুর রহমান। তিনি ভ্যাট (ভ্যালু এ্যাডেড ট্যাক্স) প্রথা চালু করেন যদিও তৎকালীন অনেক বিরোধী দল এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলো। এই ভ্যাট আজ সরকারের আয়ের এক উত্তম মাধ্যম। তিনি মুক্ত বাজার অর্থনীতির সাথে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করেন। তার আমলে আর্থিক খাতে অসাধারণ শৃংখলা ছিলো। ব্যাংক খাতে খেলাপী ঋণ কখনোই মাথাচাড়া দিতে পারেনি। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার সকল মেয়াদেই শেয়ার বাজার ছিলো চাঙা, মূদ্রাবাজার ছিলো স্থিতিশীল এবং মূল্যস্ফীতি ছিলো নিয়ন্ত্রিত। এম. সাইফুর রহমান বিশ্বব্যাংক ও আই.এম.এফ এর বোর্ড অব গভর্নর্স এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন যা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ ও ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করেছিলো চমৎকারভাবে।

সিলেটের মানুষের প্রতি তার ছিলো অফুরাণ ভালোবাসা। মফস্বল শহর সিলেটকে তিনি অত্যন্ত আধুনিকভাবে গড়ে তুলেছিলেন। সিলেট বিভাগ বাস্তবায়ণ করার মূল কৃতিত্ব তার। ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সিলেটে এসেছেন। আলীয়া মাদ্রাসা মাঠে জনসভার আয়োজন চলছে। সাইফুর রহমান এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে নাকি বলেছিলেন ‘আপনি যদি এখন এই জনসভা থেকে সিলেটকে দেশের নতুন বিভাগ হিসাবে ঘোষনা না দেন তাহলে আমি আপনার মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করবো’। তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অর্থমন্ত্রীর কথামতো সিলেটের বিশাল জনসভায় সিলেটকে দেশের নতুন বিভাগ হিসাবে ঘোষনা দেন। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সহ অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তার একক প্রচেষ্টাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।

একবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে ফাইল আসে তার টেবিলে। তিনি দেখেন সেই তালিকায় সিলেটের কোনো কলেজের নাম নাই। তার সুপারিশে ঐতিহ্যবাহী মদন মোহন কলেজের উন্নয়নের জন্য তখন ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। পাশাপাশি সিলেটের আরও অনেক স্কুল-কলেজেই তিনি সংস্কার কাজ করিয়েছিলেন। সিলেটের সাথে সংযুক্ত অনেক মহাসড়ক, সিলেটের রাস্তাঘাট, ব্রীজ-কালভার্টসহ উন্নয়ণমূলক কতো হাজার কর্মকান্ড হয়েছে তার আমলে তা সিলেটের সকলেই অবগত। কথিত আছে, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে উন্নয়ন পরিকল্পনার ফাইলে সিলেটের কোনো প্রকল্প না থাকলে তিনি নাকি বিষন্নবোধ করতেন। তাইতো লোকে বলে, আধুনিক সিলেটের রূপকার- এম. সাইফুর রহমান।

আজ ৫ সেপ্টেম্বর, এই মহান মানুষটির মৃত্যুদিবস। ২০০৯ সালের এই দিনে সড়কপথে সিলেট থেকে ঢাকা আসার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাছে এক মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৭৭ বছর। তার মৃত্যুসংবাদ স্তব্ধ করে দিয়েছিলো পুরো দেশকে। বিশেষ করে সিলেটের কোটি মানুষ অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছিলো। তার সিলেটি টানে শুদ্ধ বাংলা কথাগুলো আজও মানুষের কানে বাজে। শুধু একটা আফসোসের কথা বলে আজকের লিখা শেষ করবো।

যে সাইফুর রহমান সিলেটবাসীকে উজার করে দিলেন- আমরা তার জন্য কি করলাম? যে সিলেট শহরের প্রতি ইঞ্চিতে তার উন্নয়নের ছোঁয়া আছে- সেই সিলেট শহরে তার নামে একটা স্থাপনা কিংবা সড়কও নেই। বিশ্ববিদ্যালেয়ের কোনো ছাত্রাবাস, বড় কোনো চত্ত্বর কিংবা কোনা হাসপাতালের নামকরণ কি করা যায়না তার নামে? আমরা কি এতোটাই অকৃতজ্ঞ? যেই দেশে গুনীর কদর হয়না, সেই দেশে গুনী জন্মাবে কি করে?

2 responses to “সাবেক অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমানের ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ”

  1. Terrific article! That is the type of info that should
    be shared across the net. Disgrace on Google for now not positioning this post upper!
    Come on over and consult with my website . Thank you =)

  2. Article writing is also a fun, if you be acquainted with afterward you can write if not it is complicated to write.

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x