ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৬:৫৩ অপরাহ্ন
কনডেম সেলে থাকতে চান না ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তরা
দৈনিক ডাক অনলাইন ডেস্ক

কনডেম সেলে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গোনে ফাঁসির আসামিরা। কিন্তু এই প্রহর সহসাই শেষ হয় না। কারো কারো ক্ষেত্রে এই প্রহর শেষ হয় দেড় যুগে। আবার কারো এক যুগে। গড়ে একেক জন ফাঁসির আসামিকে ১৩-১৪ বছর কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে। আসামির চূড়ান্ত আপিল ও রিভিউ পিটিশন নিষ্পত্তির পর তাকে অপেক্ষা করতে হয় রাষ্ট্রপতির প্রাণভিক্ষার ওপর। কিন্তু ততদিনে কনডেম সেলে থেকে অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ ঐ সেলেই মৃত্যুবরণ করেন। এখন ফাঁসির আসামিদের কনডেম সেলে থাকার আইনগত কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে দায়ের করা হয়েছে এক রিট আবেদন। ঐ আবেদনে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে কনডেম সেলে আবদ্ধ না রাখার প্রার্থনা করা হয়েছে।

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের দ্বৈত বেঞ্চে এ রিটের শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামির পক্ষে এ রিট করেন। রিটে দেশের সব কারাগারে বন্দি থাকা সাজাপ্রাপ্ত ফাঁসির আসামিদের রাখার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আইজি প্রিজন্সকে প্রতিবেদন দাখিলে আদালতের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। আবেদনে ‘ডেথ রেফারেন্স জটে বছরের পর বছর কনডেম সেলে আসামিরা’ এই শিরোনামে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটিও যুক্ত করা হয়েছে।

রিটে বলা হয়েছে, বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণার পর তাত্ক্ষণিক সাজা কার্যকর করার আইনগত কোনো বিধান নেই। মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করতে কয়েকটি আবশ্যকীয় আইনগত ধাপ অতিক্রম করতে হয়। প্রথমত, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারামতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদন নিতে হবে। একই সঙ্গে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪১০ ধারা অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে আপিল দায়েরের বিধান রয়েছে। দ্বিতীয়ত, হাইকোর্ট বিভাগ মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি সাংবিধানিক অধিকারবলে আপিল বিভাগে সরাসরি আপিল দায়ের করতে পারেন। তৃতীয়ত, সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদনের আইনগত সুযোগ রয়েছে। সর্বোপরি, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের অধীন রাষ্ট্রপতির নিকট ক্ষমা চাইতে পারেন। রাষ্ট্রপতি উক্ত ক্ষমার আবেদন নামঞ্জুর করলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আইনগত বৈধতা লাভ করে কারা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু দেশের বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পরই সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নির্জন কনডেম সেলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে বন্দি রাখা হয়।

প্রসঙ্গত বর্তমানে দেশের ৬৭টি কারাগারে মোট সাজাপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা ১৫ হাজার ৯১ জন। কনডেম সেলে (নির্জন প্রকোষ্ঠে) রয়েছেন ২ হাজারের অধিক ফাঁসির আসামি।

শিশির মনির ইত্তেফাককে জানান, একজন আসামিকে কখন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বলা হবে? বিচারিক আদালতে সাজা ঘোষণার পর, নাকি রাষ্ট্রপতি বরাবর ক্ষমার আবেদন নামঞ্জুরের পর। ভারতের সুপ্রিম কোর্টে এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। ‘সুনীল বার্তা বনাম দিল্লি প্রশাসন’ মামলার রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, রাষ্ট্রপতি ক্ষমার আবেদন নামঞ্জুরের পর কোনো ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বলা হবে। অর্থাত্ সব ধরনের আইনগত অধিকার নিঃশেষ হওয়ার পরই কোনো ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বলা যাবে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরের লক্ষ্যে কনডেম সেলে বন্দি রাখা যাবে। কিন্তু আমাদের দেশে নিম্ন আদালতে ফাঁসির রায় ঘোষণার পর থেকে এক জন আসামিকে বছরের পর বছর (১৪-১৮ বছর) কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে।

অধস্তন আদালত থেকে জামিন পেলেন ৫৮ হাজার আসামি

বিচারাধীন ৮০০ ডেথ রেফারেন্স মামলা

সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন জানিয়েছে, ২০১৫ সালে নিম্ন আদালত থেকে ১১৪টি ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। আর পূর্বের বছরগুলোর অনিষ্পন্ন ডেথ রেফারেন্স ছিল ৩৬৩টি। সব মিলিয়ে ২০১৫ সালে হাইকোর্টে বিচারাধীন ছিল ৪৭৭টি। ঐ বছর নিষ্পত্তি হয় ৫৮টি। অনিষ্পন্ন ছিল ৪১৯টি। ২০১৬ সালে ১৬১টি, ২০১৭ সালে ১৭১টি, ২০১৮ সালে ১৫৪টি, ২০১৯ সালে ১৬৪টি ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। এই চার বছরে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৯৪টি। আর গত বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত হাইকোর্টে বিচারাধীন ডেথ রেফারেন্স মামলার সংখ্যা ৭৭৫টি। এই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

নিম্ন আদালতে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি বর্তমানে হাইকোর্টে চলছে। আর চলতি বছর যেসব আসামি নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হচ্ছে তাদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি হবে ২০২৬ সালে। কারণ সালের ক্রম অনুযায়ী উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানি হয়ে থাকে। ফলে এক জন ফাঁসির আসামিকে সুপ্রিম কোর্টে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বছরের পর বছর কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে।

১৪ বছর কারাভোগের পর ফাঁসির রায় বাতিল, মুক্তির প্রহর গুনছেন হুমায়ুন

অর্থাত্ চলতি বছরে ফৌজদারি মামলায় কোনো আসামির নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড হলে তার ডেথ রেফারেন্স শুনানি হবে পাঁচ বছর পর। একমাত্র অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হলেই কেবলমাত্র কোনো ডেথ রেফারেন্স মামলার দ্রুত শুনানি সম্ভব হয়ে থাকে। আর হাইকোর্ট যদি কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে তাহলে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত কমপক্ষে ১২ থেকে ১৮ বছর কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে তাকে। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে নানা প্রকৃতির অপরাধ সংঘটনের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। সংঘটিত নানা অপরাধের দায়ে অধস্তন আদালত থেকে বিভিন্ন মামলায় প্রচুর সংখ্যক আসামি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হচ্ছে।

ফাঁসির তিন আসামির আবেদন

খুনের দায়ে চট্টগ্রাম কারাগারের কনডেম সেলে থাকা সাতকানিয়ার জিল্লুর রহমান, সিলেট কারাগারে থাকা সুনামগঞ্জের আব্দুল বশির ও কুমিল্লা কারাগারে থাকা খাগড়াছড়ির শাহ আলম এ রিট দায়েরের জন্য সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে লেটার অব অথরাইজেশন দিয়েছে। এদের আপিল হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x