ঢাকা, শুক্রবার ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৪:৪১ অপরাহ্ন
নাসিবীদের ‘মৃদু প্রোপাগান্ডা’ থেকে সতর্ক হোন- মারজান আহমদ চৌধুরী
দৈনিক ডাক অনলাইন ডেস্ক

সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘মুহাররাম মাস করণীয় এবং ফজিলত’ নামে একটি পোস্টার দেখলাম। পোস্টারের লেখাগুলো ভালো। তবে শেষদিকে ‘বর্জনীয় আমলসমূহ’ বলে লেখা হয়েছে, এ দিনকে কারবালার দিন হিসেবে উদযাপন করা এবং শরীরে আঘাত করা, রক্তাক্ত করা, তাজিয়া মিছিল বের করা বর্জনীয়।

প্রথমত, কারও মৃত্যুর পর তার স্মরণে নিজের দেহে আঘাত করা, শরীর কেটে রক্তাক্ত করা, বিলাপ করা ইত্যাদি নিকৃষ্টতম বিদআত। এগুলো শিয়াদের কাজ। আহলে সুন্নাত বলে দাবী করা কোনো মাযহাব বা মাসলাক কখনও এমন কিছু করে না। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন-
لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُودَ وَشَقَّ الْجُيُوبَ وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ
“যারা (শোকে) নিজের গালে চপেটাঘাত করে, কাপড় ছিড়ে এবং জাহিলী যুগের মতো চিৎকার করে, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়।” [সহীহ বুখারী, ১২৯৭]

দ্বিতীয়ত, ওই পোস্টারে ১০ই মুহাররামকে কারবালার দিন হিসেবে উদযাপন করা বর্জনীয় বলা হয়েছে। এ কথার সাথে আমি শক্তভাবে দ্বিমত পোষণ করি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আশুরার অন্যান্য ফযিলতের সাথে এ দিনকে কারবালার স্মরণেও পালন করা যাবে, এবং করা উচিৎ।

ইসলামে কোনো বিশেষ ঘটনার স্মরণে বিশেষ দিনকে শরীয়াত সম্মতভাবে উদযাপন করা মোটেও দোষণীয় নয়, বরং সুন্নাহ। এর দলিল স্বয়ং আশুরার দিন এবং আশুরার রোজা। মদীনা তায়্যিবায় হিজরত করার পর রাসূলুল্লাহ ﷺ দেখলেন ইহুদিরা ১০ই মুহাররাম রোজা রাখে। তিনি এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা জবাব দিল, এ দিনে আল্লাহ মুসা আলাইহিস সালাম এবং বনী ইসরাইলকে ফেরাউনের হাত থেকে উদ্ধার করেছেন। তাই আমরা এ দিন রোজা রাখি। রাসূল ﷺ বললেন, “আমি তোমাদের চেয়ে মুসার অধিক নিকটবর্তী (আমরা দুজনই নবী)।” এরপর থেকে রাসূল ﷺ এ দিন রোজা রাখতেন এবং সাহাবিদেরকেও রাখার আদেশ দিতেন [সহীহ বুখারী, ২০০৪; ৪৬৮০]। এভাবেই বিশেষ ঘটনার কারণে নির্দিষ্ট দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়।

ওরা যুক্তি দেয়, রাসূল ﷺ আশুরাকে কারবালার দিন হিসেবে পালন করেননি। কি আশ্চর্য মূর্খতা! কারবালা সংঘটিত হয়েছে ৬১ হিজরিতে। রাসূল ﷺ ইন্তেকাল করেছেন এর ৫০ বছর পূর্বে, ১১ হিজরিতে। তবুও আমি বলছি, আমাদের নবী ﷺ কারবালার স্মরণে কেঁদেছেন। এটি সেই সময়ের কথা, যখন হুসাইন রা. নিজেও জানতেন না তাঁর জন্য কী অপেক্ষা করছে। সায়্যিদুনা মাওলা আলী রা. বলেছেন, আমি একদিন ঘরে প্রবেশ করে দেখি রাসূল ﷺ এর চোখ ভেজা। জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর নবী, কেউ কি আপনাকে অখুশি করেছে? আপনার চোখ ভেজা কেন? তিনি বললেন, কিছুক্ষণ আগে জিবরাইল এসেছিলেন। বলে গেলেন, আমার নাতি হুসাইন ফোরাতের তীরে শহীদ হবে। জিবরাইল আমাকে বললেন, আপনি কি ওই মাটির ঘ্রাণ শুঁকতে চান? আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন তিনি হাত বাড়িয়ে কিছু মাটি এনে আমার হাতে দিলেন। তাই আমি আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি [মুসনাদ আবু ইয়ালা, ৩৬৩; তাবরানী, ২৮১১]।

শুধু যে কারবালার আগেই আমাদের নবী ﷺ চোখের পানি ঝরিয়েছেন, তা নয়। কারবালার দিনও তিনি পরম ব্যথিত হয়েছেন এবং নিজে মক্কা-মদীনায় হুসাইনের শাহাদাতের সংবাদ পৌঁছে দিয়েছেন। মক্কায় অবস্থানরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. বলেছেন, “আমি এক দুপুরে নবী ﷺ-কে স্বপ্নে দেখলাম। চুল অবিন্যস্ত, চেহারা ধুলোমাখা, হাতে এক শিশি রক্ত। জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনার হাতে কী? তিনি জবাব দিলেন, হুসাইন ও তার সাথীদের রক্ত। আমি সকাল থেকে এগুলো সংগ্রহ করছি।” হাদীস বর্ণনাকারী বলেন, আমরা এ দিনটি স্মরণ রেখেছি এবং পরে জেনেছি যে, এ দিনই হুসাইনকে শহীদ করা হয়েছে [মুসনাদে আহমাদ, ২১৬৫]। মদীনায় অবস্থানরত উম্মে সালামাহ রা. বলেছেন, “আমি একদিন রাসূল ﷺ-কে স্বপ্নে দেখলাম। তাঁর মাথা ও দাড়িতে মাটি লেগে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, কী হয়েছে? তিনি বললেন, এইমাত্র দেখে এলাম হুসাইনকে হত্যা করা হয়েছে” [তিরমিযী, ৩৭৭১]।

এরপরও কেউ যদি বলে, হুসাইন রা. ও আহলে বাইতের শাহাদাতে ব্যথিত হওয়া, চোখের পানি ঝরানো কিংবা এ দিনকে কারবালার দিন বলা যাবে না, তাহলে সেই ব্যক্তির সাথে আমরা ‘কারবালা’ নিয়ে কথা বলব না। তখন তার সাথে কথা হবে ‘সুন্নাতের গ্রহণযোগ্যতা’ নিয়ে। কারণ ওই ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাতের ওপর-ই বিশ্বাসী নয়।

আসলে ব্যথা যদি লোক দেখানো ব্যথা হয়, তাহলে সেটি সময়ের স্রোতে মিলিয়ে যায়। কিন্তু ব্যথা যদি হৃদয়ে স্থান করে নেয়, তাহলে সেটি হারায় না। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। মক্কা বিজয়ের পর ওয়াহশী ইবন হারব ইসলাম কবুল করার জন্য রাসূল ﷺ এর কাছে আসলেন। ওয়াহশী সেই ব্যক্তি যিনি উহুদ যুদ্ধে সায়্যিদুনা হামযা রা.-কে শহীদ করেছিলেন। রাসূল ﷺ তাকে দেখে বললেন, তুমি কি ওয়াহশী? তিনি জবাব দিলেন, জ্বি। রাসূল ﷺ বললেন, তুমিই কি হামযার হত্যাকারী? ওয়াহশী বললেন, জ্বি। রাসূল ﷺ (ইসলাম কবুল করানোর পর) তাকে বললেন, তুমি কি পারবে তোমার মুখটি আমাকে না দেখাতে? তখন ওয়াহশী চলে গেলেন [সহীহ বুখারী, ৪০৭২]। একবার চিন্তা করুন। হামযা রা. ছিলেন রাসূল ﷺ এর চাচা, যার দুঃখ আল্লাহর নবী ভুলতে পারেননি। আর হুসাইন তো আমাদের নবীর বাচ্চা। রাসূল ﷺ বলতেন, “এরা দুজন (হাসান-হুসাইন) আমার বাচ্চা” [তিরমিযী, ৩৭৬৯]। সেই হুসাইনের শাহাদাতের কি এতটুকু মাহাত্ম্য নেই যে, আমরা এ দিনকে কারবালার দিন হিসেবে শরীয়াত সম্মতভাবে স্মরণ ও পালন করব?

সতর্ক হোন মুসলমান! বনু উমাইয়ার ‘রূহানী সন্তান’ নাসিবীদের প্রোপাগান্ডা থেকে সতর্ক হোন। তারা সামান্য পয়সা ও পরিচিতির জন্য আহলে বাইতের প্রতি বিদ্বেষকে মুসলমানদের মনে প্রবেশ করাতে চাচ্ছে। কিন্তু আহলে সুন্নাত সেটি হতে দিতে পারে না। আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন-
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَا يَبْغَضُنَا أَهْلَ الْبَيْتِ أَحَدٌ إِلَّا أَدْخَلَهُ اللَّهُ النَّارَ
“কসম সেই আল্লাহর, যার হাতে আমার প্রাণ। যে ব্যক্তি আমার আহলে বাইতের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।” [আল-মুসতাদরাক, ৪৭১৭]

* হাদীসের নম্বর মাকতাবাতুশ শামিলা অনুসারে

x