ঢাকা, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৯:৩৫ অপরাহ্ন
পবিত্র কুরআন নাজিলের মাস রমজান: আহমদ হাসান চৌধুরী ফুলতলী
Reporter Name

আল্লামা আহমদ হাসান চৌধুরী ফুলতলী সহকারী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও খতিব হাইকোর্ট মাজার জামে মসজিদ ঢাকা

হাইকোর্ট মসজিদে প্রদত্ত বক্তব্যের সংক্ষিপ্ত অনুলিখন:-   পবিত্র কুরআন নাজিলের মাস রমজান মাস। এ মাসটি সকল মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও ফজিলতপূর্ণ হিসেবে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যধিক। পবিত্র এই মাস প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের জীবনে আত্মশুদ্ধি, সৌভাগ্য ও গোনাহ মাফের মাস হিসেবেই পরিচিত। বরকতময় এ মাসটি রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। আর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানকে, রমজানের হককে যথাযথভাবে আদায়ের জন্য রমজানের পূর্বেই প্রস্তুতির কিছু বিষয় আছে। সেসব প্রস্তুতির কিছুটা মানসিক, কিছুটা শারীরিক। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) ২ মাস আগে থেকেই রমজানের প্রস্তুতি শুরু করতেন। অর্থাৎ, রজব মাস আসলেই রাসূল (সা.) রমজানের জন্য প্রস্তুতি নিতেন এবং তখন থেকেই তিনি বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি এই দোয়া করতেন- ‘اللهم بارك لنا في رجب و شعبان و بلغنا رمضان অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমাদেরকে রজব ও শা’বান মাসের বরকত দিন এবং রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।’

আবার, রজব মাস শেষে শা’বান মাস আসলে আল্লাহর হাবীব (সা.) অন্যান্য আমলসহ বেশি বেশি রোজা রাখতেন এবং দোয়া করতেন- ‘ اللهم بارك لنا في شعبان و بلغنا رمضان’। তিনি রমজানের প্রস্তুতিস্বরূপ রমজান ছাড়া সবচেয়ে বেশি রোজা রাখতেন কেবল শা’বান মাসেই। এ বিষয়ে রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি রমজানের সম্মানেই শা’বানে রোজা রাখি।’ আর এজন্যই বলা হয়ে থাকে, ‘রজব হচ্ছে বীজ বপনের মাস, শাবান পানি সেচের মাস এবং রমজান হচ্ছে ফসল উত্তলনের মাস।’

অধিকন্তু, যুগে যুগে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ী, তবে তাবেয়ী, ফোকাহায়ে কেরাম ও আউলিয়া কেরাম রমজানের হক আদায় ও পরিপূর্ণ ফায়দা লাভের জন্য পূর্বেই প্রস্তুতি নিতেন এবং রমজান মাস আসলে সব কাজ বাদ দিয়ে কেবল আল্লাহর জন্য এ বরকতময় মাসটি রেখে দিতে দিতেন। যেমন- ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রহ.) রমজান মাস আসলে সব কাজ বন্ধ রেখে বলতেন, ‘এই মাসটি আমি আমার আল্লাহর জন্য রাখলাম।’ আবার, এই বরকতময় মাসের রহমত, বরকত, মাগফেরাত ও নাজাত লাভ করার জন্য আল্লাহর ওলীগণ ৬ মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতেন এবং রমজান পরবর্তী বাকী ৫ মাস রমজানের আমল কবুলের দোয়া করতেন।

তাছাড়া, লাইলাতুম-মিন-নিসফে শা’বান তথা শবে বরাতের মধ্যেও রমজানের প্রস্তুতির একটি আমেজ আছে। যেমন- আল্লাহ তায়ালা ঐ সময় দুইজন ব্যক্তি ছাড়া সবাইকে মাফ করে দেন। একজন হলো মুশরিক এবং অপরজন হলো হিংসুক। এতে বুঝা যায়- রমজানের আগেই ঈমানকে জ্বালাই করতে হয় ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে নিজের মনকে পরিষ্কার করে নিতে হয়, অতঃপর আল্লাহর রহমতের দিকে দিলকে/মনকে মনোনিবেশ করতে হয়। আর এজন্যই আল্লাহর ওলীগণের ভাষ্য হলো, ‘রমজানের (১ম দশ দিনের) রহমত তারাই লাভ করতে পারে, যারা রমজানের পূর্বেই প্রস্তুতি নিয়ে নিজেকে উপযুক্ত করে। আর যে আগে থেকেই রমজানের রহমত লাভের জন্য প্রস্তুতি নেয় ও নিজেকে উপযুক্ত করে, তার জন্য রমজানের রহমত ওয়াজিব হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে তাকে মাগফেরাত ও নাজাত দান করা হয়।’

তাই, আমরা যদি রমজানের আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে পারি এবং ইবাদতের একটি রুটিন করে নিতে পারি, তাহলে রমজানে সঠিকভাবে আল্লাহর গোলামী করা ও তাঁর নৈকট্য অর্জন করা যাবে এবং এতে এই মাসের যথার্থ হকও আদায় করা সম্ভব হবে।

রমজানের আগেই যেসব প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন-

খালিছ নিয়ত করা : রমজানের যথার্থ হক আদায় করার জন্য এবং এ মাসে আল্লাহর গোলামীর মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জন করার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন নিয়তকে খালিছ করা। কেননা, খালিছ নিয়ত ছাড়া কোনো আমলই ফলপ্রসূ হয় না। যেমন আল্লাহর হাবীব (সা.) বলেছেন, ‘انما الاعمال بالنيات তথা সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।’ আর এ প্রসঙ্গে মাওলানা রুমির ভাষ্য হলো, ‘নিয়ত যদি ঠিক না হয়, তাহলে কোনো কাজ হয় না; যেমন একটা কলসিকে উল্টিয়ে সাত সাগরে ডুবিয়ে আনলেও সে কলসিতে এক ফুটো পানিও ঢুকে না।’ কাজেই রমজানের পূর্বে প্রথমেই মনকে পরিশুদ্ধ করে নিতে হবে এবং রমজানে নেক আমলের খালিছ নিয়ত করতে হবে।

দোয়া করা : রমজানকে পাওয়ার জন্য মনের গভীর থেকে দোয়া শুরু করে দেওয়া, যেন সুস্থতা ও এখলাছের সাথে রমজানের ফরজ রোজাগুলিসহ অন্যান্য ইবাদত করা যায়। রমজানের পূর্বে রাসূল (সা.) এই দোয়া বেশি বেশি করতেন, ‘اللهم بارك لنا في رجب و شعبان و بلغنا رماضان.’ আর আল্লাহর ওলীগণ এভাবেও দোয়া করতেন- ‘اللهم سلمني لرمضان، وسلم رمضان لي، وتسلمه مني متقبلا অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমাকে রমজানের জন্য এবং রমজানকে আমার জন্য সালামতপূর্ণ করে দিন। আর রমজানের রহমত-শান্তি আমার জন্য কবুল করুন।’

রোজা রাখা : রমজানের পূর্বেই রোজা রাখার মাধ্যমে রমজানে রোজা রাখার জন্য শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া। রাসূল (সা.) নিজে রমজানের প্রস্তুতিস্বরূপ শা’বানে বেশি বেশি রোজা রাখতেন। তাছাড়া, রমজানের আগে শা’বানে রোজা রাখা হলে আমাদের শরীরের গতি কী রকম হতে পারে, তা বুঝা যাবে । এক্ষেত্রে ১-২টি রোজা রাখার পর যদি শরীরে অসুবিধা হয়, তবে ডাক্তারের সাথে কথা বলে শরীরের সে সমস্যার সমাধান করিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু, এমন অসুবিধা যদি রমজান মাসে হয়, তবে তো ফরজ রোজা মিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই, দৈহিক ও মানসিক প্রস্তুতির জন্য নবীর অনুসরণে রমজানের আগেই রোজা রাখা দরকার।

রমজানকে স্বাগত জানানো : রমজানের চাঁদ অনুসন্ধান করা এবং এ মাসকে স্বাগত জানানো রাসূল (সা.) এর অন্যতম একটি সুন্নাত। রাসূল (সা.) যেভাবে রমজানকে স্বাগত জানাতেন, তা আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন এবং সেভাবেই রমজানকে স্বাগত জানানো উচিত। রাসূল (সা.) রমজানের চাঁদ দেখে তাকে স্বাগত জানিয়ে এই দোয়া পড়তেন- ‘اللهم أهله علينا بااأمن والأيمان والسلامة والاسلام والتوفيق لما تحب وترضى ربنا وربك الله অর্থাৎ, হে আল্লাহ! এ নতুন চাঁদকে আমাদের জন্য নিরাপত্তা, ঈমান, ইসলাম ও শান্তির সাথে উদয় করো। আর যা তুমি ভালোবাসো এবং যাতে তুমি সন্তুষ্ঠ হও, তা আমাদেরকে করার তাওফিক দাও। আমাদের ও তোমার (চাঁদের) রব আল্লাহ।’

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার কমানো : ফেইসবুক-ইউটিউবের ব্যবহার কমিয়ে আনা। বর্তমানে আমরা যেভাবে ফেইসবুক-ইউটিউবে অভ্যস্ত-আসক্ত; এখন থেকেই তা কন্ট্রল করতে না পারলে রমজানে ফেইসবুক-ইউটিবের নেশা সহজে ছাড়া যাবে না। এজন্যই রমজানের আগে থেকেই এগুলোর ব্যবহার কন্ট্রোল করা দরকার।

মসজিদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা: এখন থেকে বেশি বেশি মসজিদে যাওয়া ও মসল্লায় বসার অভ্যাস করা উচিত। কেননা, রমজানের পূর্ব থেকেই এ অভ্যাস না করলে রমজানে সহজে বেশি সময় মসজিদে থাকা ও মসল্লায় বসা সম্ভব হবে না। তাই, এখন থেকেই কথা-বার্তায় সংযমী হয়ে মসজিদে বেশি সময় কাটানোর চেষ্টা করা দরকার।

আত্মসংযমী হওয়া/কম খাওয়া : রমজানকে নিজের জন্য ফলপ্রসূ করার জন্য অন্যতম আরেকটা কাজ হচ্ছে- কথা-বার্তাসহ খাওয়া-দাওয়ায় সংযমী হয়ে যাওয়া। কেননা, রোজার ২টি হকের একটি হলো- আমরা যেন খাওয়া-দাওয়ায় সংযমী হয়ে তাকওয়া অর্জন করতে পারি। কারণ, কম খাওয়া হলে নিজের নফসটা দুর্বল হয় এবং নফস দুর্বল হলেই রূহানী শক্তি বৃদ্ধি পায়। আর রূহানী শক্তি বাড়লেই ঊর্ধ্ব জগতের সাথে, অর্থাৎ আল্লাহর সাথে সংযোগ স্থাপনের স্বাদ লাভ করা যায়।

দান-সদকা করা : সদকা-খায়রাত দান করার মাধ্যমে রমজানের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। নিজ পরিবারের আশপাশে যারা আছেন, অর্থাৎ প্রতিবেশীদের মধ্যে যাদের ভালো খাবারের ব্যবস্থা নেই, তাদের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা ও তাদের ঘরে খাবার পৌঁছিয়ে দেওয়া- যেন তারা সেহরি ও ইফতারে ভালো খাবার খেতে পারেন। এতে যাকাত-সদকার সওয়াব পাওয়ার পাশাপাশি আল্লাহর বান্দাদের রোজায় সহযোগিতা হবে, নিজের রোজা সহজে কবুল হবে এবং আপন মন ভালো ও প্রশান্ত থাকবে।

কুরআন তেলাওত করা : পবিত্র কুরআনুল কারীম তেলাওতের অভ্যাস করা। আগে থেকে ১-২ পৃষ্ঠা করে না পড়লে রমজানে নিয়মিত তেলাওত করা কঠিন হয়ে যাবে। তাছাড়া, যারা কর্মজীবী বা ব্যবসায়ী আছেন, তাদের এখন থেকে ব্যবসা বা কাজকর্মের সময় একটু কমিয়ে এনে অন্যান্য আমলের পাশাপাশি কুরআন পাঠ শুরু করা দরকার।

এছাড়াও, রমজানের অন্যান্য পূর্ব-প্রস্তুতিগুলি হলো পরিবারের সবাইকে নিয়ে রোজার সাধারণ মাসয়ালা-মাসায়েল জানা, ইবাদত-বন্দেগির একটি রুটিন তৈরী করা এবং যেসব কাজ রমজানে ইবাদত-বন্দেগিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে তা সমাপ্ত করা। সর্বোপরি, সবধরণের অনর্থক ও অ-ফলপ্রসূ কাজগুলি পরিহার করে সৎকাজের প্রতি মনোনিবেশ করা এবং তাওবা-ইস্তেগফার করাসহ বেশি বেশি নেক আমল করা।

পবিত্র রমজান মাস সামনেই সমাগত। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছার এবং উক্ত আমলগুলো করার তৌফিক দান করুন, আমিন। অনুলিখনে:- মহসিন আহমদ

“اللهم بارك لنا في رجب و شعبان و بلغنا رمضان”

“اللهم سلمني لرمضان، وسلم رمضان لي، وتسلمه مني متقبلا”

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x