ঢাকা, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১১:১৫ অপরাহ্ন
চা দোকানি প্রদীপ ঘোষের রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার অন্তরালের অজানা রহস্য
পাইকগাছা (খুলনা) প্রতিনিধি

ফেসবুকে ফেইক আইডির মাধ্যমে নিজেকে জার্মান প্রবাসী পরিচয়ে ভয়ঙ্কর প্রতারনার ফাঁদ পেতে বিভিন্নজনের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় গত ৫ জুলাই যশোর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে আটক হয় পাইকগাছার কপিলমুনির চা বিক্রেতা প্রদীপ ঘোষ। তালার ঘোষনগরস্থ নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় তাকে।

এদিকে তার গ্রেফতারের পর থেকে পাইকগাছার কপিলমুনি ও তালার প্রত্যন্ত এলাকায় বিষয়টি টক অব দ্য টাউনে পরিণত হয়েছে। চায়ের দোকান থেকে ভ্যান স্ট্যান্ড পর্যন্ত সকলের আলোচনার বিষয় চা প্রদীপের গ্রেফতারের বিষয়টি।

আলোচনায় আসে পরের দোকানের সামনে টেবিল পেতে বসা একজন চা বিক্রেতা থেকে রাতারাতি তার কোটিপতি বনে যাওয়ার রহস্য নিয়ে। তালার জালালপুর এলাকায় বিয়ে করে কপিলমুনি পালপাড়া এলাকায় বাসা ভাড়া নিযে থাকা চা বিক্রেতা প্রদীপ ঘোষ কিছুদিন আগে তালা উপজেলার খলিলনগর ইউনিয়নের ঘোষনগর এলাকায় জমি কিনে রাতারাতি তুলে দেন আলিসান বাড়ি। প্রায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে বহুতল ভবনের ফাউন্ডেশনে দ্বিতল বাড়ি। চাল চলনেও আসে আমুল পরিবর্তন। নিজের ব্যবহারের জন্য কেনেন দু’টি মোটর বাইক, হাতের আঙ্গুল গুলোতে ম্যাচিং করে স্বর্ণের আংটি, গলায় মোটা স্বর্ণের চেইন। কপিলমুনি বাজারের চায়ের দোকানটিও এখন আর তেমন খুলতে দেখা যায়না। এখন আর তিনি লোকের কাছ থেকে ধার নেননা বরং লক্ষ লক্ষ টাকা ধার দেন। তবে এসবের পেছনে তার অর্থের উৎস্য কোথায়?

এলাকাবাসী জানায়, তালা উপজেলার এক প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির পরিবারে নিজ মেয়েকে পাত্রস্থ করার পর থেকেই তার চাল চলনে পরিবর্তন আসে। বিভিন্ন সময়ে ঐ জনপ্রতিনিধির ও তার রিলেটিভ দেশের উচ্চ পর্যায়ের লোকদের পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন প্রদীপ ঘোষ। সুত্র জানায়, প্রদীপ দিনের বেশির ভাগ সময় মোবাইলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যয় করতেন। তবে সামাজিক মাধ্যমে তিনি কি করতেন সেটাইি অজানা ছিল সবার। তবে বছর খানেক আগে মোবাইলে প্রতারণার মাধ্যমে জনৈকা মহিলার কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় স্থানীয় এক সাঙবাদিকের মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান হয়। মূলত ঐ সময় থেকেই তার অপরাধ জগতের নমুনা খানিকটা হলেও দৃশ্যমান হয় স্থানীয়দের মধ্যে।

সর্বশেষ ৫ জুলাই যশোর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে বিপুল পরিমাণ টাকা,স্বর্নালংকার, ব্লাঙ্ক চেক,স্ট্যাম্পসহ প্রতারনার অন্যান্য আলামতসহ গ্রেফতারের পর থেকে এলাকাময় আলোচনায় আসেন প্রদীপ।

প্রসঙ্গত, গত ৫জুলাই যশোর গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে নিজ বাড়ি থেকে হাতিয়ে নেওয়া নগদ ১০ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ও বিভিন্ন ডকুমেন্টসসহ গ্রেফতার হন প্রদীপ। সূত্র জানায়, ঐরাতে প্রদীপের বাড়িতে অভিযানের সময় মাত্র ৯৭ হাজার টাকা ও অন্যান্য আলামত পাওয়া যায় সেখানে। বাকি ১০ লাখ টাকা ও স্বর্ণালংকার তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক পার্শ্ববর্তী জালালপুর এলাকায় তার এক শ্যালক দিবাশীষের কাছ থেকে উদ্ধার হয়।

যশোর জেলা পুলিশের প্রেস কনফারেন্সে জানানো হয়, প্রদীপ ঘোষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজেকে Soumodip Ghosh (susanto ghosh) নামে পরিচয় দিয়ে একটি ফেইক আইডি খুলে। এসময় সে নিজেকে জার্মান প্রবাসী পরিচয় দিয়ে জমি ক্রয়ের কথা বলে প্রতারনার মাধ্যমে প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা রীতা রাণী দাস’র নিকট থেকে গত জুনের বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে নগদ,বিকাশ ও চেকের মাধ্যমে মোট ২০ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা গ্রহন করে। এসময় প্রদীপ ঐ শিক্ষিকার কাছ থেকে জমির দলিল তৈরীর নামে এনআইডি কার্ডের ফটোকপি, পাসপোর্ট সাইেজের ৩ কপি ছবি, স্বাক্ষরযুক্ত নন জুডিশিয়াল ব্লাঙ্ক স্ট্যাম্প, স্বাক্ষরযুক্ত ৩টি চেক গ্রহন করে। এরপর ঐ শিক্ষিকা প্রতারিত হয়েছেন বুঝতে পেরে আত্মসাৎকৃত টাকাসহ অন্যান্য উপকরণগুলি উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে যশোর কোতযালী মডেল থানায় একটি মামলা করেন। যার নং-৮। তারিখ-০৩/০৭/২০২১। ধারা: ৪০৬/৪১৭/৪২০/৪৬৮/৫০৬ দ:বি:।

এরপর যশোর পুলিশ সুপার মামলাটির তদন্তভার জেলা গোয়েন্দা শাখায় অর্পন করলে গোয়েন্দা শাখার অফিসার ইনচার্জ মামলাটির তদন্তভার এসআই(নি:) শামীম হোসেনের উপর অর্পন করেন।

এরপর পুলিশ সুপারের সার্বিক দিক-নির্দেশনায় ও জেলা গোয়েন্দা শাখার অফিসার ইনচার্জ সোমেন দাস এর তত্ত্বাবধানে পুলিশ পরিদর্শক (নি:) রুপম কুমার সরকারের (পিপিএম) নেতৃত্বে এসআই মোঃ মফিজুল ইসলাম, (পিপিএম), এসআই চন্দ্র কান্ত গাইন, এসআই মোঃ শামীম হোসেন সঙ্গীয় ফোর্সসহ গোয়েন্দা শাখার একটি চৌকস টিম প্রদীপের অবস্থান শানাক্ত করে রবিবার (৪ জুলাই) খুলনার কপিলমুনি ও সাতক্ষীরার তালা উপজেলার ঘোষ নগরে অভিযান চালিয়ে ঘটনার মূল নায়ক প্রদীপ কুমার ঘোষ ওরফে সঞ্জিত ওরফে সৌম্মদীপ ঘোষ ওরফে সুশান্ত ঘোষ (৫১) কে সোমবার (৫ জুলাই) তালার ঘোষনগরস্থ নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করেন। এসময় তিনি ঘোষনগরের সুবোধ ঘোষের ছেলে বলে জানানো হয়।

এসময় পুলিশ তার কাছ থেকে নগদ ১০ লাখ ৯৭ হাজার টাকা, বাদীর স্বাক্ষর সম্বলিত ব্লাঙ্ক চেক, বাদীর স্বাক্ষরিত ব্লাঙ্ক নন-জুডিশিয়াল ষ্ট্যাম্প-৩টি, বাদীর এনআইডি কার্ডের ছায়ালিপি ২টি, ৩ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি, বিভিন্ন দলিলের ছায়ালিপি, ৩টি মোবাইল সেট (ফেসবুক আইডি ব্যবহৃত ও বিকাশ নাম্বার) সম্বলিত, প্রদীপের ১টি পাসপোর্ট, সাড়ে ৩ ভরি স্বর্ণালংকার যার আনুমানিক মূল্য ২ লক্ষ ৮৬ হাজার টাকা উদ্ধার করেন।

এদিকে গ্রেফতারের পর তথ্যানুসন্ধানে তার পারিবারিক সূত্র জানায়, প্রদীপ ঘোষরা ২ ভাই ও ২ বোন। তার বাবার নাম মৃত সুবোধ ঘোষ। আদি বাড়ি ঝাউডাঙ্গা। পরে সকলে ভারতে পাড়ি জমালেও প্রদীপ ফের দেশে ফিরে আসেন। বাবা-মা ও এক ভাই ও এক বোন ইতোমধ্যে মারা গেছেন। দেশে ফিরে প্রদীপ বিয়ে করেন, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জালালপুর এলাকার পরিমল ঘোষের মেয়েকে। এরপর কপিলমুনির পালপাড়া এলাকার জনৈক অনিমেষ মন্ডলের বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকেন প্রায় ১৭ বছর। এসময় তিনি কপিলমুনি স্বর্ণ পট্টির একটি দোকানের বারান্দায় চায়ের দোকান দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। ঐসময় তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য কানেকশন নিয়ে মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। দাম্পত্য জীবনে প্রদীপ ঘোষ ১ ছেলে ও ১ মেয়ের পিতা। কিছুদিন আগে তালা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ঘোষ সনৎ কুমারের মেঝ ভাই সুভাস ঘোষের ছেলের সাথে তার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিজ পরিচয় সম্প্রসারিত করেন।

সম্প্রতি সে কপিলমুনির এক ওষুধ ব্যবসায়ীর ঘোষনগরস্থ প্রায় ৮ শতক জমি ক্রয় করে সেখানে বহুতল ভবনের ফাউন্ডেশনে দ্বিতল আলিসান বাড়ি তৈরি করেন। সম্প্রতি ব্যাপক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বাড়ির উদ্ভোধন করেন প্রদীপ। এসময় বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিসহ দু’উপজেলার বিশিষ্ঠ ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয় ঐ অনুষ্ঠানে।

2 responses to “চা দোকানি প্রদীপ ঘোষের রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার অন্তরালের অজানা রহস্য”

  1. … [Trackback]

    […] Read More to that Topic: doinikdak.com/news/33632 […]

  2. … [Trackback]

    […] Read More Info here to that Topic: doinikdak.com/news/33632 […]

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x