সফল ও উন্নত জীবনের পাশাপাশি দায়িত্বশীল সমাজ গঠনে বিষয়ভিত্তিক সুশিক্ষিত মানব সম্পদ জরুরী। আর এ জন্য পারিবারিক সুশিক্ষার সঙ্গে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ অনেক সময়ই রুদ্ধ হয়ে পড়ে, উচ্চতর শিক্ষার অভাবে। রাতের অন্ধকার সরিয়ে তেজদীপ্ত সূর্যের আলোকছটা যেমন ধরনীতে প্রান সঞ্চারী করে তোলে তেমনি বিষয় ভিত্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত মেধাবীরা যে কোনো সমাজ এবং দেশের টেকসই উন্নয়নের মূল বুনিয়াদ।
বর্তমান সরকার উচ্চ শিক্ষাকে জাতীয় অগ্রাধিকারে স্থান দিয়েছেন। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে শিক্ষার এই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রায় ২০ লক্ষ জনগনের আবাস ভোলা জেলায় ৩৭টি কলেজ ১৭৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকলেও আমাদের নেই কোন বিষয় ভিত্তিক সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি নেই কোনো কৃষি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও। এতে একদিকে যেমন প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষার সন্ধানে যাত্রাকরা দ্বীপ জেলা ভোলার সেরা মেধাবীরাই একদিন সেই শহরে ফিরতে আর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য, রাজনীতি এমনকি চাকরি ও ব্যবসা বাণিজ্যে রাজধানীসহ দেশ ও বিদেশের অন্যান্য বড় শহরগুলোতে হয়ে ওঠে তাদের স্থায়ী বসবাস। যাদের অনেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মণ্ডলে স্বীয় মেধায় অনন্য হলেও তাতে ভোলার ভাগ্য পাল্টায় নি।
জন্মশহরের জন্য এ অবস্থা মেধার পাচার নয় কি? এ প্রশ্ন আজ দেশের সুশিল সমাজে প্রতিনিধিদের কাছে রাখছেন ভোলাবাসী, আর কতদিন এ অবস্থা চলবে?
নাটোর সদর উপজেলায় একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, নাটোরের সিংড়া উপজেলায় একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের নির্বাচনী এলাকা মেহেরপুরে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায়ও রয়েছে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে বিচ্ছিন্ন জেলা হিসেবে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন এতদিনেও না পাওয়াটা ভোলাবাসীর জন্য হতাশার নয় কি? এ কি ভোলার জনগনের উপর অমানবিকতা নয় কি ?
এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকারের একটি হলো উপযুক্ত চিকিৎসা প্রাপ্তি। চিকিৎসা সেবা দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে জনগণের দুয়ারে পৌঁছে দেয়ার প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে তা সহজলভ্য হয়ে উঠছে না। এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন হতে পারছে না প্রধানত চিকিৎসকের অভাবে। সরকারি তথ্যে দেখা যায়, দেশের ৫৫ শতাংশ মানুষ এখনো মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। বেসরকারী হিসাবে যা ৬৮ শতাংশ। সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ধারণায় ২০৩০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে ও সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে, অথচ আমাদের দেশে চিকিৎসা পেতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, এর ৬৭ শতাংশই রোগীকে বহন করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা বৈষম্য আছে। বৈষম্য আছে গ্রামে ও শহরে, আছে ধনী ও দরিদ্র শ্রেণীতে। শহরের মানুষ গ্রামের মানুষের চেয়ে স্বাস্থ্যসেবা বেশি পাচ্ছেন।
শহরের ৬০ শতাংশের বেশি প্রসূতি প্রসবকালে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সেবা পান। আর গ্রামের প্রসূতিদের ক্ষেত্রে এই হার ৪০ শতাংশের নিচে। শহরের প্রায় ৮০ শতাংশ মা প্রসব উত্তর সেবা পান, গ্রামে তা ৬০ শতাংশের কম। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে শহরের শিশুদের তুলনায় গ্রামের শিশুদের চিকিৎসকের কাছে নেয়া হয় কম।
এক্ষেত্রে ভোলার অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা। যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম নদী হওয়ার কারনে বিরূপ আবহাওয়ায় এই অঞ্চলের মানুষ সঠিক চিকিৎসা সেবা পেতে চরম দুর্বিষহ পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। ভালো চিকিৎসার জন্য ঢাকা, বরিশাল যাওয়ার সুযোগ হয় না মৃত্যু পথযাত্রী রোগীদের, কিন্তু একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ থাকলে সেই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে হয়তো মুক্তি পেতো ভোলাবাসী।
মানসম্মত কোনো মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল না থাকায় প্রতিদিন অসংখ্য লোক বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। এখনো জেলার ৬৫ শতাংশ রোগীই চিকিৎসা নিচ্ছেন অপ-চিকিৎসকের কাছে। কেউ ছুটছেন ওষুধের দোকানে, কেউ বা হাতুড়ে ডাক্তারের চেম্বারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যোগ্য চিকিৎসকের পরিবর্তে অপ- চিকিৎসকদের কাছ থেকে সেবা নেয়ার কারণে ছোটখাটো সমস্যাও জটিল আকার ধারণ করছে। ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স’ হয়ে পড়েছে শরীর। চিকিৎসাপ্রার্থীদের বড় অংশই যাচ্ছে ওষুধের দোকানে। ফার্মেসি, ডিসপেনসারি বা কম্পাউন্ডারের কাছ থেকে চিকিৎসাসেবা নেয় ৩৩ দশমিক ১১ শতাংশ রোগী। অথচ প্রায় সব দেশেই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলো আধুনিক চিকিৎসার মূল কেন্দ্র। দেশ-বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অধ্যাপকেরা শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের পাঠদানের পাশাপাশি হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। অন্যদিকে এসব মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করে নবীন চিকিৎসকেরা নিকটস্থ শহর-উপশহরে ক্লিনিক, হাসপাতাল গড়ে চিকিৎসাসেবাকে পৌঁছে দিতে পারেন তৃণমূলে।
আমাদের জেলার বেশির ভাগ রোগীরা বরিশাল এবং ঢাকার মেডিক্যাল কলেজগুলোতে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। দূর-দূরান্ত থেকে রোগীরা এসে চিকিৎসা নিতে গিয়ে যোগাযোগ, আসা-যাওয়া ও খাবারের জন্য নিঃস্ব হয়ে পড়েন। ২০১১ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মেডিক্যাল কলেজ বঞ্চিত জেলায় মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে স্বাস্থ্য অধিকার সুরক্ষার জন্য সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে দুঃখে বিষয় হলো আজও আমরা পাইনি সেই সুযোগ। আজও আমাদের জনপ্রতিনিধিরা একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ তৈরীতে আগ্রহী নন।
আমাদের প্রাণপ্রিয় এই শহরে ধনী গরিব ভেদে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর মেধার সুন্দর বিকাশ ঘটাতে এবং চিকিৎসা সেবাকে মানুষের জন্য সহজলভ্য করতে ভোলাতে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি। এর পাশাপাশি ভোলার খনিজ গ্যাস ও অপাড় সম্ভাবনার পর্যটন শিল্পকে এতদিনেও সার্বিক কাঠামোয় দাঁড় করাতে না পারাটা আমাদের জন্য চরম ব্যর্থতা।
ভোলাবাসীর প্রাণের এসব দাবি নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরেই সামাজিক ঐক্যের ডাক দিয়ে আসছে জেলার সবচেয়ে বড় সামাজিক সংগঠন” ব-দ্বীপ ফোরাম”। ইতোমধ্যেই যেখানে একাত্বতা প্রকাশ করেছেন শহরটির আপামর জনসাধারন। এর আগে পৃথক পৃথক ভাবে জেলার অন্যান্ন সামাজিক সংগঠন গুলোর উদ্যোগে কয়েকটি দাবী নিয়ে মানবন্ধন করা ও স্বারকলিপি দেওয়া হয়েছে । কিন্তু তাতেও টনক নড়েনি আমাদের নেতাদের। সম্মিলিত ভাবে এবং আলাদা ভাবে যারা এই মহান দাবী নিয়ে মানবন্ধন ও স্বারকলিপি দেওয়ার কাজ করেছেন সে সকল সংগঠনের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন ভোলার সাধারন জনগন।