ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০১:২৬ অপরাহ্ন
চলাফেরা খেয়াল খুশি মতো নিয়ন্ত্রণ অসাংবিধানিক: হাইকোর্ট
Reporter Name

নাগরিকের চলাফেরা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের খেয়াল খুশি অনুযায়ী তা নিয়ন্ত্রণ বা বারিত করা অসাংবিধানিক বলে অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট।

মো. আতাউর রহমান বনাম সরকার মামলার রায়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ অভিমত দিয়েছেন।

মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের (ইউনিভার্সেল অব হিউম্যান রাইটস) ১৩ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়েছে, ‘আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৩৬ -এ মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার ১৩ অনুচ্ছেদের প্রতিফলন ঘটেছে। ব্যক্তির চলাফেরার স্বাধীনতা যা তার জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত। তাতে হস্তক্ষেপ করা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।’

‘কোনো নাগরিকের চলাফেরা তথা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার উপর বিধি নিষেধ আরোপ করতে হলে সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সুনির্দিষ্ট কারণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অবশ্যই জানাতে হবে, যাতে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট তার বক্তব্য প্রদানের সুযোগ পান।’

এই রায়ে আদালত বলেছেন, ‘জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ শব্দসমূহ গুরুত্বপূর্ন ও প্রণিধানযোগ্য। উপরোক্ত বিধান অনুসারে কোনো নাগরিকের চলাফেরার স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ বা বারিত করতে হলে তা হতে হবে প্রথমত: জনস্বার্থে এবং দ্বিতীয়ত: সুনির্দিষ্ট আইনের দ্বারা। এধরনের গৃহীত পদক্ষেপ শুধুমাত্র জনস্বার্থে হলেই চলবে না- তা হতে হবে সুনির্দিষ্ট আইনের দ্বারা; আবার শুধু আইনের দ্বারা হলেও চলবে না- হতে হবে জনস্বার্থে। কোনো ব্যক্তির চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ বা বারিত করতে হলে উপরোক্ত দু’টি শর্তই পূরণ অপরিহার্য; দুই শর্তের একটি পূরণ হলে অপরটি না হলে তা আইন সংগত হবে না।

হাইকোর্ট তার রায়ে আরো বলেছেন, ‘সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আদালতের সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট অভিমত এই যে, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন তদন্ত সংস্থা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত হবে যে, অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে যে কোনো অপরাধের সাথে জড়িত সন্দেহভাজন কোনো ব্যক্তিকে দেশ ত্যাগে বারিত করার জন্য অবিলম্বে প্রয়োজনীয় আইন বা বিধি প্রনয়ন করা। এবং যতক্ষণ পর্যন্ত এই ধরণের আইন বা বিধি প্রণয়ন করা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত অন্তবর্তী ব্যবস্থা হিসেবে এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতের নিকট এ ধরণের বারিত আদেশ প্রার্থনা করা এবং আদলতের অনুমতি গ্রহণ করা। তবে এ সংক্রান্ত আইন-বিধি না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বতী ব্যবস্থা হিসেবে উচ্চ আদালত থেকে এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে এই রায়ে।

এই রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থা/কর্তৃপক্ষ যথাযথ প্রতিনিধির মাধ্যমে এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে আবেদন জানালে আদালত সন্তুষ্টি সাপেক্ষে একটি সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য, যার মেয়াদ ৬০ দিনের অধিক হবে না বারিত আদেশ কিংবা স্বীয় বিবেচনায় ন্যায় সংগত অন্য কোনো আদেশ প্রদান করতে পারবে। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা পক্ষ ওই আদেশ বাতিল বা প্রত্যাহার করার জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতে আবেদন জানাতে পারবে এবং সেক্ষেত্রে আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শ্রবণ এবং কাগজাদি, যদি দাখিল করা হয় পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় আদেশ প্রদান করতে পারবে। বারিত আদেশের মেয়াদ বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থা/কর্তৃপক্ষ পুনরায় সংশ্লিষ্ট আদালতে আবেদন করতে পারবে এবং আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষ যদি কাগজাদি দাখিল করে তা বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ আদেশ প্রদান করবে।

রায়ে হাইকোর্ট আরো বলেছে, ‘একজন নাগরিকের চলাফেরার স্বাধীনতা ব্যক্তিজীবনের স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত, যা শাশ্বত। এ স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে হলে আইন নির্ধারিত নিয়মে বা পদ্ধতিতে করতে হবে; অর্থাৎ কোনো নাগরিকের চলাফেরার মৌলিক অধিকার নিয়ন্ত্রণ বা বারিত করতে হলে তা করতে হবে আইন বা বিধি অনুসারে,জনস্বার্থে। যার বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে তার অধিকার রয়েছে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের কারণসমূহ জানার। ‘আইনানুগ বিচার (ন্যাচারাল জাস্টিস)’র মূল কথাই হল কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের পূর্বে তাকে অবশ্যই আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।’

এই রায়ে বলা হয়েছে, ‘আমাদের বলতে দ্বিধা নেই যে, নাগরিকের চলাফেরার সাংবিধানিক অধিকার কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের খেয়াল খুশি অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ বা বারিত করা অসাংবিধানিক। তবে এটাও বাস্তবতা যে, অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে সন্দেহভাজন বা অভিযুক্ত অনেকে বিভিন্ন অজুহাতে দেশ ত্যাগ করছে এবং পরবর্তীতে তাদের আর আইন-আদালতের সম্মুখীন করা সম্ভব হচ্ছে না। এই সকল বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে দুর্নীতি বা অর্থপাচার সংক্রান্ত মামলায় কিংবা অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রেও অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে দেশ ত্যাগে বারিত বা তার চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন বা বিধি প্রণয়ন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, যা সময়ের চাহিদাও বটে।

এর আগে সম্পদের তথ্য চেয়ে নরসিংদীর আতাউর রহমানকে নোটিস দেয় দুদক। তিনি তথ্য দাখিল করার পর ২২ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধানে নামে দুদক। সে অনুসন্ধান চলাকালে গত বছর ২০ ডিসেম্বর আতাউর রহমান যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারেন, সে জন্য ইমিগ্রেশন পুলিশকে চিঠি দেয় দুদক। দুদকের এই সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ব্যবসায়ী আতাউর রহমান হাইকোর্টে রিট করেন। সে রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট দুদকের নোটিসের বৈধতা প্রশ্নে রুল জারি করে। এরপর শুনানি নিয়ে রুলটি যথাযথ ঘোষণা করে গত ১৬ মার্চ রায় দেয় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ। রায়ে হাইকোর্ট বলেন, দুর্নীতি মামলার আসামি বা সন্দেহভাজন ব্যক্তির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) বিশেষ জজ আদালত থেকে অনুমতি নিতে হবে। হাইকোর্টের দেয়া ওই রায়টি রোববার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করা হয়। এদিকে এ রায়টি স্থগিত চেয়ে দুদক চেম্বার আদালতে আবেদন করলে গত ২২ মার্চ চেম্বার আদালত রায়ে হস্তক্ষেপ না করে দুদকের আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানি জন্য পাঠিয়ে দেন।আগামী সোমবার সে শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। নিউজ সোর্সঃ নাগরিকের চলাফেরা খেয়াল-খুশিমতো নিয়ন্ত্রণ অসাংবিধানিক: হাইকোর্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published.