ঢাকা, শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৩৫ পূর্বাহ্ন
আজ মুক্তিযোদ্ধা, ব্যান্ড গুরু আজম খানের ১০ তম প্রয়াণ দিবস
ভাস্কর সরকার (রা.বি):

মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান (জন্ম: ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০ মৃত্যু: ৫ জুন, ২০১১, ঢাকা) একজন বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধা, জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী, অভিনেতা, ক্রিকেটার ও বিজ্ঞাপনের মডেল ছিলেন। তিনি আজম খান নামে সর্বাধিক পরিচিত। তাকে বাংলাদেশের পপ ও ব্যান্ড সঙ্গীতের একজন অগ্রপথিক বা গুরু হিসেবে গণ্য করা হয় । তার গানের বিশেষত্ব ছিল পশ্চিমা ধাঁচের পপগানে দেশজ বিষয়ের সংযোজন ও পরিবেশনার স্বতন্ত্র রীতি। আজম খানের জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ (রেল লাইনের ঐ বস্তিতে), ওরে সালেকা ওরে মালেকা, আলাল ও দুলাল, অনামিকা, অভিমানী, আসি আসি বলে ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় সংঘটিত কয়েকটি গেরিলা অভিযানে তিনি অংশ নেন। প্রথম কনসার্ট প্রদর্শিত হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনে ১৯৭২ সালে।

তার পারিবারিক ও সামাজিক জীবন ছিলো ধন্ধু সুলভ, পাড়ার সকলের সাথে তার আন্তরিকতার সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো ৷ আজম খানের মায়ের নাম জোবেদা খাতুন। তাঁর বাবা মোহাম্মদ আফতাবউদ্দিন খান তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগতভাবে হোমিওপ্যাথির চিকিৎসক ছিলেন। আজমের তিন ভাই ও এক বোন ছিল। বড় ভাই সাইদ খান (সরকারি চাকরিজীবী), মেজো ভাই বাংলা চলচ্চিত্রের প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক আলম খান; আলম খানের তত্ত্বাবধানে আজম খানের প্রথম গান রেকর্ডিং হয়েছিল। ছোট ভাই লিয়াকত আলী খান (মুক্তিযোদ্ধা) এবং ছোট বোন শামীমা আক্তার খানম। ১৯৮১ সালের ১৪ই জানুয়ারি ঢাকার মাদারটেকে তিনি সাহেদা বেগমকে বিয়ে করেন। তাঁদের ঘরে জন্ম নেয় এক ছেলে এবং দুই মেয়ে। প্রথম সন্তানের নাম ইমা খান, দ্বিতীয় সন্তান হৃদয় খান এবং তৃতীয় সন্তান অরণী খান। স্ত্রী সাহেদা বেগমর সাথে সেপারেশনের পর যাবার পর থেকে একাকী জীবনযাপন করেন তিনি।

প্রারম্ভ ও উচ্চারণ ব্যান্ড সম্পাদনা আজম খানের কর্মজীবনের শুরু প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশকের শুরুতে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পর ১৯৭২ সালে তিনি তাঁর বন্ধুদের নিয়ে ‘উচ্চারণ’ ব্যান্ড গঠন করেন। তাঁর ব্যান্ড উচ্চারণ এবং আখন্দ (লাকী আখন্দ ও হ্যাপী আখন্দ) ভ্রাতৃদ্বয় দেশব্যাপী সঙ্গীতের জগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বন্ধু নিলু আর মনসুরকে গিটারে, সাদেক ড্রামে আর নিজেকে প্রধান ভোকালিস্ট করে অনুষ্ঠান করেছেন। ১৯৭২ সালে বিটিভিতে সেই অনুষ্ঠানের ‘এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে এবং চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দু’টি সরাসরি প্রচার হলো। ব্যাপক প্রশংসা আর তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দিলো এ দুটো গান। দেশজুড়ে পরিচিতি পেয়ে গেলো তাঁদের দল। ১৯৭৪-১৯৭৫ সালের দিকে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাংলাদেশ (রেললাইনের ঐ বস্তিতে) শিরোনামের গান গেয়ে হৈ-চৈ ফেলে দেন। তাঁর পাড়ার বন্ধু ছিলেন ফিরোজ সাঁই। পরবর্তীকালে তাঁর মাধ্যমে পরিচিত হন ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজের সাথে। এক সাথে বেশ কয়েকটা জনপ্রিয় গান করেন তাঁরা। এরই মধ্যে আরেক বন্ধু ইশতিয়াকের পরামর্শে সৃষ্টি করেন একটি এসিড-রক ঘরানার গান জীবনে কিছু পাবোনা এ হে হে! তিনি দাবি করেন, এটি বাংলা গানের ইতিহাসে- প্রথম হার্ডরক।

এক যুগ’ নামে তাঁর প্রথম অডিও এলবাম ক্যাসেট প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। ১৭টি একক, ডুয়েট ও মিশ্রসহ সব মিলিয়ে তাঁর গানের অ্যালবাম ২৫টি। তাঁর প্রথম সিডি বের হয় ১৯৯৯ সালের ৩ মে ডিস্কো রেকর্ডিংয়ের প্রযোজনায়। আজমের উল্লেখযোগ্য অ্যালবামের মধ্যে আছে দিদি মা, বাংলাদেশ, কেউ নাই আমার, অনামিকা, কিছু চাওয়া, নীল নয়নতা ইত্যাদি। মৃত্যুর পর আগস্ট ১১, ২০১১ সালে ইম্প্রেস অডিও ভিশনের ব্যানারে ‘গুরু তোমায় সালাম’ নামে তার সর্বশেষ এলবাম প্রকাশিত হয় ৷ তার উচ্চারণ ব্যান্ডের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য সম্পাদনায় যে এ্যালবামগুলো প্রকাশিত হয় সেগুলো হলো- অভিমানী, আলাল ও দুলাল, দিদিমা, বাংলাদেশ বাংলাদেশ,

ফেলে আসা দিনগুলো পিছু ডাকে, কেউ নাই আমার, আর দেখো না, ব্যস্ত ভবঘুরে, আর গাইবো‌না গান, থাকবো না যেদিন, রকস্টার

বর্ষাকাল, মাটির পৃথিবীতে, নতুন পুরান, নীল নয়না, কিছু চাওয়া, অনামিকা, পুড়ে যাচ্ছে, গুরু তোমায় সালাম, ওরে সালেকা ওরে মালেকা,

পাপড়ি কেন বোঝে না, চাঁদকে ভালবেসো না,

হাইকোর্টের মাজারে ইত্যাদি ৷

সঙ্গীতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। এছাড়া তিনি ২০০২ সালে কোকাকোলা গোল্ড বটল পদক, আজীবন সম্মাননা পান হলিউড থেকে ডিসকো রেকর্ডিংয়ের সৌজন্যে, টেলিভিশন দর্শক পুরস্কার, ১৯৯৩ সালে বেস্ট পপ সিঙ্গার অ্যাওয়ার্ড পান, এছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা পান ‘কাউন্সিল অব আরবান গেরিলা ঢাকা ’৭১ ও রেডিও টুডের পক্ষ থেকে’ ৷

এই মহান মানুষটি জুন ৫, ২০১১ ইং মাত্র ৬১ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ইহলোক ত্যাগ করেন৷

মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, মিরপুর, ঢাকাতে তাকে কবর দেয়া হয়৷

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x