ঢাকা, মঙ্গলবার ০৮ জুলাই ২০২৫, ০৮:৪৭ পূর্বাহ্ন
রাজশাহী অঞ্চলের লোকসঙ্গীত: বারাসিয়া গান
ভাস্কর সরকার (রাবি প্রতিনিধি)

প্রত্মতাত্ত্বিকদের মতে সমগ্র বাংলাদেশ হচ্ছে একটি ব-দ্বীপ, প্রাগৈতিহাসিক কালে এই সমগ্র-অঞ্চলটি ছিল সমূদ্রের তলভূমি। স্মরণাতীতকালে ধীরে ধীরে হিমালয় পর্বত সহ বঙ্গভূমি নামের এই ব-দ্বীপটি সমূদ্রের তলদেশ থেকে জেগে ওঠে এবং কালক্রমে এখানে সভ্যতার বিকাশ ঘটে। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় হিমালয় পর্বত তথা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল বাংলার প্রাচীনতম ভূ-ভাগ। কেননা প্রত্মতাত্ত্বিকদের অভিমত হচ্ছে সমূদ্রের তলদেশ থেকে সবার আগে জেগে ওঠে হিমালয় পর্বত এবং তার পাদদেশ। এরপর ধিরে ধিরে বাংলাদেশের পূর্ব দক্ষিণ এবং সবশেষে দক্ষিণবাংলার নিন্মাঞ্চল সমূদ্রের তলদেশ থেকে জেগে উঠে। এ তথ্য অনুযায়ী হিমালয়ের পাদদেশ সংলগ্ন বাংলাদেশের সবচেয়ে উচ্চতম এবং প্রাচীনতম ভূ-ভাগই যে বরেন্দ্র অঞ্চল ইতিহাসে তার প্রমাণ মেলে। ঐতিহাসিকগণের মতে রাজশাহী, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদের কিছু অংশ, দার্জিলিং ও কোচবিহারসহ গঠিত অঞ্চলকে বরেন্দ্র অঞ্চল হিসাবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস  প্রসঙ্গে বরেন্দ্র গবেষক প্রফেসর সাইফুদ্দীন চৌধুরী বলেন, বহু শতাব্দীর পুরাতন জনপদ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, ভৌগোলিক বিভাজনে যা একালের রাজশাহী বিভাগ-এককালে যার পরিচয় ছিল বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রী। পশ্চিমে গঙ্গা ও মহানন্দার মিলিত স্রোতধারা, পূর্বে করতোয়া, দক্ষিণে পদ্মা এবং উত্তরে কোচবিহার ও তরাইয়ের মধ্যবর্তী এ ভূ-খন্ড অনেক সভ্যতা ও উত্থান-পতনের পাদপীঠ।  রাজশাহী অঞ্চল বলতে আমরা বুঝি নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং রাজশাহী জেলার সমাহার। কেননা দেশ বিভাগের পরে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চল বলতে এই চার জেলার সমাহারকে বোঝান হত। এই চার জেলা মিলে রাজশাহী জেলা ছিল। কিন্তু আশি দশকের পর থেকে এই জেলাকে ভেঙ্গে চার জেলায় বিভাজন করা হয়। মূলত এই চার জেলার সমাহারকেই বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চল বলা হয়।

সঙ্গীত ভাবনার ভুবনে এক সুন্দরতম প্রকাশ মাধ্যম। মানব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং কর্ম পরিবেশে সঙ্গীতের ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষনীয়। সঙ্গীত অপছন্দ করে এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল। যদি দু’একজন পাওয়া যায় তাদেরকে মার্টিন লুথারের ভাষায় শয়তান বলে আখ্যায়িত করা যায়। সঙ্গীতের সুমিষ্ট ও সুমধুর সুরধ্বনি যে ব্যক্তির মনকে অভিভূত করেনা তার দ্বারা সর্বোচ্চ ঘৃণ্য কর্ম সম্ভব। চিত্ত স্ফুর্তি ও উদ্দীপনার অভাবে সে ব্যক্তির মন রাতের মত বিকল ও নিস্তব্ধ। এরূপ ব্যক্তিকে বিশ্বাস করা অনুচিত। কেননা সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে যে সব সৃজনশীল উপহার আমরা লাভ করেছি সঙ্গীত তার মধ্যে অন্যতম। মানব জীবনে সংস্কৃতি চর্চার শ্রেষ্ঠ অঙ্গ সঙ্গীত সাধনা। বর্তমানে সঙ্গীতের তিনটি ধারা বর্তমান যথাঃ ক) শাস্ত্রীয় সঙ্গীত খ) ব্যান্ড সঙ্গীত এবং গ) লোক সঙ্গীত। লোকসঙ্গীত ফোকলোর অঙ্গনে একটি বলিষ্ঠ উপাদান। লোকসমাজের চিন্তা-চেতনার ধারক ও বাহক লোকসঙ্গীত।

গ্রামীণ বাংলার প্রাণস্পন্দন এদেশের লোকসঙ্গীতেই প্রতিধ্বনিত হয়। মৃত্তিকালগ্ন মানুষের সুখ-দুঃখ, বিনোদন ও আশা-আকাঙ্খার সামগ্রিক পরিচয় বহন করে এই লোকসঙ্গীত। লোকসমাজের পরিবর্তনের ধারায় লোকসঙ্গীত বংশ পরম্পরায় এবং লোকের মুখে মুখে বহমান।

ধানের দেশ গানের দেশ আমাদের বাংলাদেশ। এ দেশের লোকসঙ্গীত ভান্ডারে বারসিয়া গান একটি সমৃদ্ধ সদস্য। লোকসঙ্গীত গবেষক হাবিবুর রহমান অঞ্চল ভিওিক লোকসঙ্গীতকে দশটি ভাগ করেছেন। তিনি বারসিয়া অঞ্চল  বলতে  সমগ্র পাবনা জেলা এবং রাজশাহী জেলা, নাটোর ও নওগাঁ জেলার সিংড়া, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, রানীনগর ও আত্রাই থানা নিয়ে বর্তমান বারসিয়া সঙ্গীতাঞ্চল হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। আর সমগ্র বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে বারসিয়া সঙ্গীতাঞ্চল বলতে, সমগ্র কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা (রামপাল, সরোন খোলা, মোরলগঞ্জ, পাইকগাছা, দাকোপ ও শামনগর থানা ব্যতীত) ; ফরিদপুর (মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলা ব্যতীত); ঢাকা , টাংগাইল, (মধুপুর থানা ব্যতীত); ময়মনসিংহের জামালপুর (শ্রীবর্দী, ঝাড়িয়াগাঁতি, নাক্লা , দেওয়ানগঞ্জ, শেরপুর ও নলিতাবাড়ী ব্যতীত) এবং সিলেট জেলার সদর থানা (জয়ন্তিয়া ও গোয়াইন ঘাট ব্যতীত), মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক, জগন্নাথপুর ও হবিগঞ্জ সদর, চুনারঘাট, বাহুবল ও নবীগঞ্জ থানার কথা বলেছেন। এ থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশে বারসিয়া গানের প্রভাব কতখানি। মূলত রাজশাহী অঞ্চলকে কেন্দ্র করেই বারসিয়া গানের বিকাশ। ধিরে ধিরে সমগ্র বাংলাদেশ ছড়িয়ে পড়ে। যদিও বারসিয়া গানের উদ্ভব প্রসঙ্গে হাবিবুর রহমান বলেন, যশোহর জেলার মোহম্মদপুর ও লোহাগড়া থানার উত্তর দক্ষিণে ২৫ মাইল প্রলম্বিত বারসিয়া নামে মধুমতী নদীর একটি উপনদী রয়েছে। এক সময় এ নদী বর্ষায় ২৩০ গজ প্রশস্ত হতো এবং সারা বৎসর নাব্য থাকত কিন্তু বর্তমানে মৃত প্রায়। বারসিয়া নদীর দুপাড়ে প্রচলিত বারাশি গানের সাথে নদীর নামের শব্দগত মিল রয়েছে। এ থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে, বারসিয়া নদীর নাম থেকেই বারাশে  (বারাসী, বারাসিয়া, বারাইস্যা ও বারাইসা ) সঙ্গীতের নামকরণ করা হয়েছে এবং ঐ এলাকা হতেই এ গানের উদ্ভব ঘটেছে বলা যায়।

ভাওয়াইয়া আগে না ভাটিয়ালী আগে; এ বিষয়ে সঙ্গীত বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে অবশ্য এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, ভাটিয়ালী আগে। কেননা ভাটিয়ালী গান নদীকেন্দ্রিক। এছাড়া এ গানের সাথে শ্রমের একটা সম্পর্ক বিদ্যমান। কিন্তু ভাওয়াইয়া অবসরের গান। ভাটিয়ালীর সাথে নৌকার সম্পর্ক এবং ভাওয়াইয়ার সাথে গরুর গাড়ীর সম্পর্ক চিরন্তন। চাকার আবিস্কারের অনেক পূর্বে নৌকার আবিস্কার হয়েছিল। তাই ভাটিয়ালীই প্রাচীন সঙ্গীত। একই কারণে বারসিয়া গানও নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে না। কেননা এ গানের সঙ্গে গরুর গাড়ীর সম্পর্ক বিদ্যমান এবং এ গানও অবসরের গান।  গ্রামের সাধারণ মানুষের যখন কাজ কর্ম থাকে না তখন এই গান গীত হয়। তবে এই গানের বিশেষত্ব হল যে, জীবিকার সন্ধানে যখন গাড়োয়ানেরা মালপত্র নিয়ে দূর দেশে যেত। মাসের পর মাস পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতো। পুরুষচিত্ত ব্যাকুল থাকতো  ঘরে ফেরার তাগিদে। তখন গাড়ী চালাতে চালাতে অতৃপ্ত মনের কামনা বাসনা এই বারসিয়া গানের মধ্যদিয়ে প্রকাশ করত। রাজশাহী অঞ্চলে এখনও গ্রামের মেঠো পথে গরু বা মহিষের গাড়ি চালকেরা গলা ছেড়ে বারসিয়া গান গেয়ে থাকে। ক্ষেত্র সমীক্ষায় দেখা যায়, নাটোর জেলার লালপুর, বাগাতীপাড়া, বড়াইগ্রাম, গুরুদাশপুর থানার অনেক গাড়োয়ানেরা গাড়ীর বহর নিয়ে এই প্রযু্িক্তর যুগেও চলনবিল অর্থাৎ সিংড়া, চাটমোহর, আত্রাই, ভাঙ্গুরা, পাবনা ইত্যাদি অঞ্চলে ধান বাইতে যায়। তাদের মুখেই এখনও বারসিয়া গানের  অস্তিত্ত্ব বর্তমান। আর তাদের দ্বারাই এই গান চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে । আজ বারসিয়া গান বেতার, টেলিভিশনে গাওয়া হচ্ছে। কিন্তু এর প্রকৃত ধারক বাহক ও সৃষ্টি কারক হিসাবে অজপাড়াগাঁয়ের নিরক্ষর গারোয়ানদেরই চিহ্নিত করতে হয়।

‘বারসিয়া’ নামটি নিয়েও যথেষ্ট মতানৈক্য বর্তমান। এ প্রসঙ্গে লোকসঙ্গীত গবেষক মাযহারুল ইসলাম তরু বলেন, বারাশে গানকে বিভিন্ন গবেষক বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছেন। আব্দুল হাফিজ এ গানকে ‘বারাসী’ বলে অভিহিত করেছেন। প্রবীন শিক্ষাবিদ ও গবেষক এম, এ, হামিদ একে বলেছেন ‘বারোষা’ । শহীদুল হক খান এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে এ গানকে ‘বারসিয়া’ বলে উলে­খ করেছেন। নিষ্ঠাবান গবেষক সমীয়ুল ইসলাম ‘বারইস্যা’ বলে এ গানকে অভিহিত করেছেন। বাংলা একাডেমীর ফোকলোর উপবিভাগের সংগৃহীত পান্ডুলিপিতে এ গানকে ‘বারাইস্যা’ বলে উলে­খ করা হয়েছে। তবে খুব সম্ভব বারাশি সঙ্গীত বারোমাষি নামটির সংক্ষিপ্ত রূপ। মূলত বারমাসি থেকেই বারসিয়া ( বারমাসি > বারমাসিয়া > বারসিয়া ) শব্দের উৎপত্তি। শব্দে ধ্বনি আগম ও ধ্বনি লোপের বিবর্তনের ফলে বারমাসি থেকে বারসিয়া উৎপত্তি হয়েছে। আবার বারসিয়া, বারাশে, বারইস্যা, বারোষা, বারাষী ইত্যদি নাম ধারণ করেছে অঞ্চলভিত্তিক।  বারসিয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে বারসিয়া শিল্পী জনাব ফজলুর রহমান (বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতার, গ্রাম ও পোষ্ট: ওয়ালিয়া , লালপুর, নাটোর-৬৪২০) বলেন, বারমাসিয়া থেকেই বারসিয়া গানের উৎপওি। এই গান বারমাসই গাওয়া হত। বিশেষ করে শীতের সময় এই গান আরও বেশী শোনা যেত। শীতের দিনে গাড়োয়ানেরা হাটে মাল নিয়ে যেত। রাতে ফেরার পথে বারসিয়া গান গাইতে গাইতে আসত , দূর থেকে সে গান শুনতে অপূর্ব লাগতো। এছাড়া বার মাস গাড়িতে মাল টানার সময় এই গান গাইত। গাড়িতে যাওয়া কিংবা মাঠে কাজ করার অবসরে বারসিয়া গান গাওয়া হত।

আরেকজন বারসিয়া শিল্পী জনাব মকসেদুল আলম (বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতার, গ্রাম ও পোষ্ট: ওয়ালিয়া, লালপুর,  নাটোর-৬৪২০) বারসিয়া গান সম্পর্কে বলেন, বারসিয়া গান পূর্বের গাড়োয়ানেরা গাড়ি বাইতে গিয়ে গাইত। কিংবা মাঠে কাজ করতে গিয়ে ধুমুক (অবসর) সারার সময় গানগুলি গাইত। তারা গানগুলি মুখে মুখে রচনা করে গাইত। এই গানের কোন রচয়িতা নাই। ধীরে ধীরে এই গান একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে। তাই বারসিয়া গানে কথা উলট-পালট (উল্টা-পাল্টা) হয়।

ও দ্যাওরারে…….

কি দূ:খে পিরিত শিখাইলে

পিরিতী করিতে চাও

ছাড়ো দ্যাওরা ওরে বাপও মাও

আরও ছাড়ো এই দ্যাশের মমতারে।

কি সাইতে বাড়াইলাম পাও

খেয়া ঘাটে ওরে নাইকো নাও

এ ঘাটের মাঝিকে খাইছে বনের বাঘেরে।

আমাকে যে করবে পার

দান করিব হায়রে সোনার হার

পার হইয়া যৌবন করবো দানও রে।

চল দ্যাওরা বাড়ি যাই

মন্দ বলবে ওরে বাপ মায় রে।। (নিজস্ব সংগ্রহ)

কথান্তর:

ও দ্যাওরারে…….

পিরিতী করিতে চাও

ছাড়ো দ্যাওরা ওরে বাপ মাও

আরো ছাড়ো এ দ্যাশের মমতারে

ও দ্যাওরারে কি দূঃখে পিরিতী শিখাইলি।

আমাকে যে করবে পার

দান করিব হায়রে গলার হার

পার হইয়া যৌবন করবো তারে দানও রে।

কি সাইতে বাড়ালাম পাও

খেয়া ঘাটে ওরে নাইকো নাও

এই ঘাটের পাটনিকে খাইছে বনের বাঘেরে।। (নিজস্ব সংগ্রহ)

বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত গবেষক আতোয়ার রহমান বলেন, বারসিয়া গান রচনার সূচনা বৎসরের প্রথম মাস বৈশাখের উল্লেখ দিয়ে, শেষ চৈত্রে।  কিন্তু খুব কমই বারসিয়া আছে যে সব গান বারমাসের নামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। তবে বর্ষাকালে যখন মানুষের কাজ থাকতোনা তখন অবসর কাটানোর জন্য এই গানগুলি গাওয়া হত। নিম্নে বর্ষাকালের উল্লে­খ আছে এমন একটি গান :

জষ্টি না আষাঢ় রে মাসে

ঝাঁকে চলেরে মাছ

রাধে যাইবে জল ভরিতে

কানাই লাগলো পাছে লো সই।

এতো রাইতে কে বাঁশরী বাঝায়

রাধের গামছা কালার বাঁশী

রাখে একই রে ঠাঁই

রাধের গামছা রাধে পাইলো

কালার বাঁশী নাই ওলো সই।

তরলা বাঁশের বাঁশী পিতলের বাঁধা

লোগের কড়ে মুখের ফুয়ে বলে

রাধা রাধা লো সই।

যেইনা ঝাড়ের বাঁশের বাঁশী

সেইনা ঝাড়ে যাব

কুড়ালে কাটিয়া বাঁশ

সাগরে ভাসাব লো সই।। (নিজস্ব সংগ্রহ)

ক্ষেত্রসমীক্ষায় প্রাপ্ত গান গুলিতে বার মাসের নাম উলে­খ না থাকলেও কিছু গানে দুই একটি মাসের উল্লেখ্য দৃষ্টিগোচর হয়। তবে গান গুলিতে বারমাসের নাম না থাকলেও বারমাসের দূ:খের কথা চিত্রিত হয়েছে।

আবাল কালের জানা শুনা

দিতে চাইয়াছিলি নাকের সোনা

বন্ধুরে কথা দিয়া কথা রাখলা না

ও মোর বন্ধুরে কথা দিয়া কথা রাখলা না।

আসতে চাইয়াছিলি কাল শ্রাবনে

শ্রাবন বিদায় নিল পড়ল ভাদর রে

বন্ধুরে আমার দিকে ফিইরা চাইলানা

ও মোর বন্ধুরে আমার দিকে ফিইরা চাইলানা ।

আমি মরি ভরা যৌবনে

জনম গেল বৃথায় প্রেম আগুনে

বন্ধুরে মরন কালে দেখা দিলানা

ও মোর বন্ধুরে মরন কালে দেখা দিলানা । (নিজস্ব সংগ্রহ)

উপরিউক্ত গানে শুধু বারমাসের বর্ণনাই নয় সারা জীবনের না পাওয়ার বেদনা পস্ফিুটিত হয়েছে। মানব জীবনের অনেক চওয়া পাওয়া অপূরণীয়। অবসরে সে কথা গুলো উঁকি দেয় মনমন্দিরে। বলার মত কোন মানুষ নাই , তখন অবচেতন ভাবেই অব্যক্ত কথা গুলো সুরের মালা জড়িয়ে বেড়িয়ে আসে। বারসিয়া গানেও সেই চিত্র দৃষ্টিগোচর হয়।

বর্তমান বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের অবস্থা প্রাচুর্যপূর্ণ। তবে লোকসঙ্গীতের বন্ধু লোকবাদ্যযন্ত্র ছাড়া আধুনিক যন্ত্র দিয়ে লোকসঙ্গীত পরিবেশিত হচ্ছে বিধায় অতল গভীরে হরিয়ে যাচ্ছে লোকসঙ্গীতের প্রকৃত রূপ-রস ও আমেজ। মূলত শিল্প বিপ্লবের ফলে গ্রামীণ সমাজ আজ বিলুপ্তির পথে, মানুষ আধুনিক জীবনযাত্রার সাথে অভ্যস্ত হচ্ছে। তাই নগরজীবনে গ্রামীণ সমাজের ভূমিকা দিনে দিনে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। লোকসঙ্গীত সাধারণত গ্রামীণ সমাজ হতে সৃষ্টি। লোকসঙ্গীতকে বলা যায় গানের বাহিরানা অর্থাৎ ঘরানার বাইরে। কিন্তু আজ লোকসঙ্গীতকে বাঁধা হচ্ছে ঘরানায়। হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের প্রাণের আবেগ, প্রাণের সুর।

প্রাবন্ধিক:

ভাস্কর সরকার,

পিএইচ.ডি গবেষক

ফোকলোর বিভাগ,

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ৷

x